আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মরণ করে একটি কাহিনী
সময় ১৮৭০-৭১ । যুদ্ধ চলছে । প্রুশিয়ার বিসমার্কের বাহিনী ফ্রান্সের আলসেস লোরেনের দখল নিয়েছে ।
দৌড়োতে দৌড়োতে স্কুলের দিকে ছুটে চলেছে একটি ছেলে । নাম তার ফ্রানজ । ফ্রানজ-এর মাস্টারমশায় হ্যামেল স্যার ব্যাকরণের পার্টিসিপ্ল্ নিয়ে পড়া ধরবেন আজ । অথচ পার্টিসিপ্ল্ এক দানা পড়া হয় নি ফ্রানজ-এর । ওদের ভাষায় কথাটা হল ‘পার্তিসিপে’ । একে পার্তিসিপে পড়া হয় নি বিন্দু বিসর্গ । তার ওপর স্কুলে যেতে এত দেরি । খুব ভয়ে ভয়ে ছিল ফ্রানজ । মন বলছিল স্কুলে না যেতে পারলেই যেন ভালো ছিল । কিন্তু যেতে যখন হবেই , দৌড় ছাড়া গতি নেই । দৌড়োতে দৌড়োতে সে টাউন হলের কাছে এসে পড়ে ।
টাউন হলের বাইরে বোর্ড । বোর্ডে খারাপ খবরগুলো এসে ঝুলে থাকে । সেই বোর্ডের সামনে সেদিন বেশ ভিড় । ভিড়ের মধ্য থেকে কে এক জন , ফ্রানজকে দেখে বলল , –স্কুলে যাবার জন্য আর ছুটতে হবে না রে । ফ্রানজ ভাবল , দেরি দেখে লোকটা ওকে ঠট্টা করছে । ফ্রানজ হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুলে পৌঁছল ।
কিন্তু স্কুলটা যেন আজ অন্য রকম মনে হচ্ছে । কেমন যেন একটা থমথমে ভাব । মাস্টারমশাই হ্যামেল স্যার স্কুলের বারান্দাতেই ছিলেন । হাতে তার বেত । যেমন থাকে অন্য দিন । অবাক কান্ড ! দেরির জন্য ফ্রানজকে তিনি বকলেন না । বরং শান্ত গলায় বললেন , –যাও ক্লাসে গিয়ে বসো ।
ফ্রানজ ক্লাসে গিয়ে বসল । বন্ধুরা আগেই এসে গেছে । কিন্তু ক্লাসের পেছনের বেঞ্চগুলোতে শহরের বয়স্ক মানুষগুলো কেন । শহরের মেয়র এসেছেন । বয়স্কদের হাতে পুরোনো বই । একজন আবার একটা বর্ণ পরিচয়ের বইয়ের মাঝখানে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছেন ।
ফ্রানজ লক্ষ করল , হ্যামেল স্যার সেদিন পরে এসেছেন সবুজ কোট । ঝালর দেওয়া জামা । ঝালরে আবার সুতোর নকশা করা । মাথায় সিল্কের টুপি । সাধারণ পোশাক নয় । এই পোশাক তিনি পরেন প্রাইজ-ডে-তে । কিংবা যেদিন ইন্সপেক্টর আসেন ।
পাঠ দেবার জায়গায় দাঁড়িয়ে হ্যামেল স্যার শুরু করলেন , প্রিয় শিশুরা , এই আমার শেষ পড়ানো । বার্লিন থেকে নির্দেশ এসেছে , আলসেস লোরেনের সব স্কুলে কাল থেকে শুধু জার্মান পড়ানো হবে । ফরাসি আর পড়ানো হবে না । তোমাদের সঙ্গে আমার এই শেষ ফরাসি পড়ানো ।
ফ্রানজ অবাক হয়ে যায় । স্যার বলে যাচ্ছেন , আমার খুব আফশোশ হ্য় , জানো , তোমরা এমন সুন্দর একটা ভাষা তেমন করে তো পড়লে না । নিজেদেরকে বলেছ , বুঝিয়েছো – ঠিক আছে , আজ পড়া না হলেও কাল ঠিক পড়ে নেবো । আগামী কাল আর পাবে না । আগামী কাল আর ফরাসি শেখার সুযোগ পাবে না । আমার নিজের উপরেও আফশোশ , আমি কেন আরও বেশি করে তোমাদের পড়ালাম না । আরও ভালো করে । কেন ছুটির দিনেও তোমাদের ডেকে এনে ফরাসি শেখাতে পারলাম না । আজ তো শেষ । কাল তো নেই ।
প্রিয় শিশুরা, মনে রেখো, ফরাসি হল সব থেকে সুন্দর ভাষা । সব থেকে যুক্তিসিদ্ধ । সহজ । অন্যরা হয় তো আমাদের দেশ দখল নেবে । ভাষাটা ভুলো না । নিজের ভাষা ভুলে যাওয়া মানে কারাগারের চাবিটা হারিয়ে ফেলা।
হ্যামেল স্যার ব্যাকরণ পড়াতে শুরু করলেন । যেমন চল্লিশ বছর ধরে পড়িয়ে এসেছেন । ফ্রানজের মনে হল , সে যেন সবটুকু বুঝতে পারছে । আগে কেন এমন মন দিয়ে বোঝেনি । ফ্রানজের মনে হল , হ্যামেল স্যার যেন ফরাসি ব্যাকরণের সবটুকু আজ পড়িয়ে শেষ করতে চাইছেন । যত দূর , যত গভীরে যাওয়া যায় ফরাসি ব্যাকরণের । আজই । তিনি থামলেন । কোন শব্দ নেই । পায়রাগুলো আপন মনে বকম বকম করছে । ওরা কি পায়রাগুলোকেও জার্মান ভাষায় কথা বলাবে না কি । কিছু একটা বলছেন হ্যামেল স্যার ।
তোমরা হয় তো ফরাসিই থাকবে । ফরাসি থাকার ভান করবে হয় তো । কিন্তু ফরাসি বলবে না । ফরাসি বলতে ভুলে যাবে ।
চুপ করে স্থির হয়ে আছেন হ্যামেল স্যার । বাইরের বাগান , এই স্কুল ঘর । এই চত্বর । এই ভাষা । সব ছেড়ে যেতে হবে তাঁকে ।
দেওয়ালের দিকে ফিরলেন । চক তুলে নিলেন হাতে । ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন , বড়ো বড়ো করে —ভিভা লা ফ্রাঁসে
ফ্রান্স জয়ী হোক । ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক । তার পর বলে উঠলেন হঠাৎ , স্কুল শেষ হলো ।
(*ঋণ : মূল গল্প—আলফোঁস দোদে (১৮৪০—১৮৯৭)/ ফ্রানজের গল্প/ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ শনিবার ‘গণশক্তি’পত্রিকার ‘সাত সকাল’-র পাতায় প্রকাশিত শুভময়-এর রচনা থেকে সংকলন)
বিমল কান্তি দাশগুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং চিত্রশিল্পী।