আগুন দেখেছি আমি
মধ্যাহ্নের সাক্ষাৎকার : অনুরাগ মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কিছুক্ষণ
আলাপ একটি রাজনৈতিক সভায়। মৈত্রেয়ীদিকে আমাদের পত্রিকা দিলাম। সেই সংখ্যায় ‘লিঙ্গ বর্ণালী’ সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বিষয়ে আলোচনা করতে করতেই একদিন সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ। রবিবারের একটি দুপুরে ফলের ডালা সাজিয়ে মৈত্রেয়ীদি গল্প করতে বসলেন। গল্পের মাঝে কথোপকথন লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ এ যে মোষ তাড়ানোর গল্প, জাগরণের গল্প, আগুনের ফুল্কি থেকে দাবানল জ্বলে ওঠার গল্প।
লিঙ্গ প্রসঙ্গে আলাপচারিতায় সাধারণত যে দুটি প্রশ্ন প্রথমেই উঠে আসে তা হল : ‘প্রথম কবে নিজের প্রকৃত যৌনতা সম্পর্কে সচেতন হলেন?’ এবং ‘প্রথম কাম আউট কবে?’। মৈত্রেয়ীদি নিজে থেকেই প্রথম প্রশ্নটি এই আলোচনায় উঠে আসার কথা বলে জানালেন যে প্রত্যেক সাক্ষাৎকারেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর রয়েছে। নিজের ব্যাক্তিগত উপলব্ধি প্রকাশ্যে ব্যক্ত করা সহজ নয়। তাছাড়া মনে থাকার কথাও না। বয়ঃসন্ধির অনেক উপলব্ধিই প্রথমবারে অর্থ বহন করে না। বরং বারংবার ঘটনার পুনরাবৃত্তিই রহস্যের উন্মোচন করে। দ্বিতীয় প্রশ্নের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮৬৭ সালে বিবদমান সিটি স্টেটগুলি যখন সংযুক্ত জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে এল, তখন অনুষ্ঠিত সংযুক্ত আইন সভায় প্রকাশ্যে কার্ল হাইনরিখ আলরিখ নবগঠিত রাষ্ট্রের পিনাল কোড থেকে ‘সোডোমি আইন’ বাতিল করার দাবি জানিয়েছিলেন। মানা হয়নি। কিন্তু এটিই বোধহয় আধুনিক যুগে প্রথম ‘কাম আউট’-এর ঘটনা। এর আগে বেশিরভাগ জেন্ডার অ্যাক্টিভিস্টরা ছদ্মনামে তাঁদের বক্তব্য প্রকাশ করতেন। পরিচিত মহল থেকে নির্বাসিত হওয়ার সম্ভাবনার ফলে ‘কাম আউট’ প্রত্যেক অন্যান্য যৌনতার মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় সংগ্রাম। মৈত্রেয়ীদি অর্থনৈতিক অবস্থানের নিরিখে ‘কাম আউট’-এর জটিলতার কথাগুলি বললেন। সামাজিক ক্ষেত্রে সম্মানহানির সম্ভাবনা সত্ত্বেও আর্থিক সচ্ছলতা ‘কাম আউট’-এর উৎসেচক হয়ে দাঁড়ায়। আবার আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী না হওয়ায় প্রান্তিক পরিবারের অন্যান্য যৌনতার মানুষের লড়াই অনেক বেশি কঠিন।
অনুরাগ মৈত্রেয়ী
প্রথম দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রশ্ন পেরিয়ে আমাদের আলোচনা এগিয়ে চলল। ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে চপল ভাদুড়ি। ঋতুপর্ণ থেকে চৈতন্যদেব। লিঙ্গ বর্ণালী ভারতীয়, বলা ভালো, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এর সমাজের পরিপন্থী — এ হেন রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে হিন্দু শাস্ত্রে প্রান্তিক যৌনতা সম্পর্কে উল্লেখ থাকার কথা উঠে এলেও মৈত্রেয়ীদি ধর্মীয় ভাবাবেগকে আমল দিতে নারাজ। তাঁর এই অবস্থানে আমার পুরাণ বিশেষজ্ঞ দেবদত্ত পট্টনায়কের একটি উক্তির কথা মনে পড়ে গেল : ‘Beware of a land where celibate men decide what is good sex’, অর্থাৎ, ‘সেই স্থান থেকে সাবধান যেখানে ব্রহ্মচারীরাই প্রকৃষ্ট যৌনতার মান স্থির করে’। মৈত্রেয়ীদি লিঙ্গ পরিবর্তনের অনিবার্যতার বিরুদ্ধে সওয়াল করলেন এবং নিজের যৌনতা সম্পর্কে গর্ব অনুভব করাতেই জোর দিলেন। ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’-এর কথা আমার মনে পড়ে গেল। বিশ্বের প্রথম লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রচেষ্টা। অসফল। প্রাণ হারাতে হল চিত্রশিল্পী আন্দ্রেয়াস ওয়েগনারকে। আজকের দিনে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও সফলতা যথেষ্ট কম। ঝুঁকি অনেক বেশি। কিন্তু মৈত্রেয়ীদি এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতেও নারাজ। ‘একাধিক যৌন সম্পর্ক সম্বন্ধে তোমার কি মত?’ — এই প্রশ্নে মৈত্রেয়ীদি ঈষৎ হেঁসে বললেন ‘আমি বড় সেকেলে। যাকে ভালবাসবো তার প্রতি মানসিকভাবে কমিটেড থাকতে চাই।’ কিন্তু সমর্পিত জীবনের চেয়ে স্বাধীনতা তাঁর কাছে বেশি পছন্দের। অবশ্য পছন্দের মানুষের প্রতি অনুরক্ত বা সমর্পিত থাকাকে মৈত্রেয়ীদি অপরাধ বা পরাধীনতা বলে মনে করেন না। তাঁর কথায় ‘এটাও তো রামধনু পতাকার আরেকটি আলোর ছটা’।
শেষ প্রশ্ন অবশ্যই রাজনৈতিক। ‘এই অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের অভিমুখ কি?’ — মৈত্রেয়ীদির কথায়, “৩৭৭ ধারা উচ্ছেদ হলেই বৈষম্যের অবসান হবে না, কিন্তু আইনি স্বীকৃতি বিরোধী শিবিরকে সতর্ক করবে”। বৈষম্যের অবসান আমুল সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে অধিকার অর্জনের এই লড়াই অন্যান্য শোষিত ও নিপীড়িতদের সঙ্গে সংযুক্ত মোর্চা গঠন ছাড়া চালিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এখানে আমার একমাত্র সংযোজন — এই মোর্চার নেতৃত্বে থাকুক মেহনতী জনগণ, বিশেষত এগিয়ে থাকা মজদুর শ্রেণী। পাথেয় হোক অগাস্ট বেবেল, ক্লারা জেটকিনদের মতবাদ। যখন যোগী মুখ্যমন্ত্রী ‘অ্যান্টি ভ্যালেন্টাইন স্কোয়াড’ তৈরিতে ব্যস্ত, তখন মেহনতিরাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পরিসর লিঙ্গ স্বীকৃতির আন্দোলনকেও ব্যাপৃত করুক, এটাই যুগের দাবী।
কিছু প্রশ্নোত্তর লড়াইয়ের সামগ্রিক চিত্র কখনই ফুটিয়ে তোলে না। রাস্তায় নেমে অধিকার অর্জনের লড়াই কতটা দুরূহ তা প্রত্যেক অন্যান্য যৌনতার মানুষের অজানা নয়। তবুও দুপুরের এই আলাপচারিতায় দাবানল হয়ে ওঠায় অঙ্গিকারবদ্ধ আগুনের ফুল্কি আগামীদিনের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের যে দ্যোতনা দিয়ে গেল তার এক টুকরো প্রতিচ্ছবি রাখা থাকল এই রচনায়…
(অনুরাগ মৈত্রেয়ী একজন সমাজকর্মী। তাঁর সঙ্গে আলোচনায় ‘জবরদখল’ পত্রিকার তরফে সুমিত ঘোষ।)