
হীরকের রাজা উদয়ন পণ্ডিতকে অবজ্ঞা করে ভূলুন্ঠিত হয়েছিলেন। সাম্প্রতিক কালের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য স্তরে শিক্ষার বেহাল দশার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলায় এবার “দিল্লী”-র দূত এবং “দিদিকে বলো”-র শাগরেদদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলতেই হবে “দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান”।
মমতা ব্যানার্জীর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে অভিষিক্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি তালিকার একটি স্তম্ভ ছিল বিদ্যালয়ের পার্শ্ব শিক্ষকদের স্হায়ীকরণ এবং বেতন বৃদ্ধি। ২০০৯-এর সেই প্রতিশ্রুতি ২০১৯-এ এসেও উন্নয়নের পোস্টমাস্টারকে পৌঁছে দিতে পারেনি সেই পার্শ্ব শিক্ষকদের দরজায়। ১৬ই আগস্ট পার্শ্ব শিক্ষকরা তাঁদের চাকরীর স্হায়ীত্ব অর্জন এবং সম কাজে সম বেতনের দাবিতে সল্ট লেকের করুণাময়ী থেকে মিছিল করে বিকাশ ভবন পর্যন্ত যাত্রা করেন এবং সেখানে অবস্হান বিক্ষোভ এবং আমরণ অনশনের কর্মসূচি নেন। “পার্শ্ব শিক্ষক ঐক্য মঞ্চ” থেকেই সমগ্র কর্মসূচির নেতৃত্ব দান করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে একাধিক পার্শ্ব শিক্ষকদের সংগঠন যৌথ সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে তাঁরা এই ঐক্য মঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁদের আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলার জন্য। কিন্তু, সমগ্র মিছিলের ওপর হামলে পড়ে পুলিশ এবং আধা সেনা! তৃণমূলের তরফ থেকে নেওয়া “দিদিকে বলো” প্রকল্পের আওতায় থেকেই পার্শ্ব শিক্ষকরা চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁদের আবেদন পৌঁছে দিতে কিন্তু তাঁদের সেই কর্মসূচিতে আচড়ঁ ফেললেন স্বয়ং “দিদি”-ই! তাঁর বাহিনী আটকে দিল শিক্ষকদের এই শান্তিপূর্ণ মিছিলকে; সল্ট লেকের একাংশে জারী হল ১৪৪ ধারা…
হুগলী জেলার ধনিয়াখালি সার্কেলের একটি বিদ্যালয়ের একজন পার্শ্ব শিক্ষক এবং ঐক্য মঞ্চের রাজ্য কমিটির সদস্য শোভন ব্যানার্জীর বক্তব্য, লোয়ার প্রাইমারীর পার্শ্ব শিক্ষকরা ভাতা পান ৮,৮০০ টাকা এবং আপার প্রাইমারীর পার্শ্ব শিক্ষকরা ভাতা পান ১৩,০০০ টাকা যা দিয়ে সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতিতে তাঁদের অন্যতম দাবি, গত ১৪-১৫ বছর ধরে চলে আসা ভাতা পদ্ধতি বন্ধ করে তাদের পে স্কেল নির্ধারণ করতে হবে। ‘পূর্ণ’ শিক্ষকদের মতো তাঁরাও সমান পরিমাণে কাজ করছেন কিন্তু বেতন সমান পরিমাণে পাচ্ছেন না। তাঁরা পূর্ণ শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রতিটি কোর্স সম্পূর্ণ করেছেন কিন্তু তাও তাঁদের নিয়োগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। বরাহনগর রামেশ্বর হাইস্কুলের পার্শ্ব শিক্ষিকা কাকলী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে করুণাময়ীতে, যেখান থেকে তাঁদের বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল, সেই স্হানে সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ নামিয়ে সমগ্র অঞ্চল ফাকাঁ করে দেওয়া হয়। এখানেই শেষ নয়… পুলিশ তাঁদের হুমকি দেয় যে তাঁরা বিকাশ ভবনের সামনে পৌঁছালে তাঁদের আটক করা হবে এবং পুলিশি হেফাজতে রাখা হবে। অবিনাশপুর থেকে আসা মৌলানা মহম্মদ সামিমুদ্দিনের কথায়, প্রবল বৃষ্টি এবং পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার পার্শ্ব শিক্ষক সল্ট লেকের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছেন কিন্তু তাঁরা আবার একত্রিত হয়ে অনশন মঞ্চের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল, আবেদন মঞ্জুর না হওয়া অব্দি তাঁরা তাঁদের অনশন চালিয়ে যাবেন। আন্দোলনকারীদের মুখে তখন একটাই স্লোগান-“আমরা আছি রাস্তার ধারে, দিদি তুমি এসি ঘরে, মানছি না, মানবো না”।
১৭ই আগস্ট কল্যাণী ষ্টেশনের পার্শ্ববর্তী বাস টার্মিনাসের পাশে পার্শ্ব শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে নির্মমভাবে লাঠি চালায় পুলিশ। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ব্যারাকপুরেও। ১৮ই আগস্ট পুলিশের লাঠিচার্জের প্রতিবাদে নতুন করে শিক্ষকদের জমায়েত হতে থাকলে বিজেপি নেতা অর্জুন সিং ঘোলা জলে মাছ ধরতে চলে আসেন। মূলত বামপন্থী ও দলিত গণসংগঠন এবং কিছু নাগরিক সংগঠনের মিলিত প্রয়াসে চলতে থাকা এই আন্দোলনে বাহ্যিকভাবে কোনও রাজনৈতিক রঙ এতদিন না লাগলেও অর্জুনের নেতৃত্বে এর গায়ে গেরুয়া ছাপ লাগানোর চেষ্টা চলছে। মনে রাখা দরকার, বিজেপি পার্টিগতভাবে অন্যান্য রাজ্যে পার্শ্ব শিক্ষকদের আন্দোলন নির্মমভাবে দমন করে এসেছে। রাজস্থানে তাদের সরকার থাকাকালীন মাদ্রাসার পার্শ্ব শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ঝাড়খন্ডেও পে স্কেলের বদলে পার্শ্ব শিক্ষকদের ভাতা ব্যবস্থাই বহাল রাখার পক্ষে সওয়াল করেছে বিজেপি সরকার। ফলে, অর্জুনের এই কুম্ভীরাশ্রু কতটা পার্শ্ব শিক্ষকদের দাবীর পক্ষে আর কতটা দিলীপ ঘোষের পাদুকা স্পর্শলাভের উদ্দেশ্যে তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে, কংগ্রেসও এই আন্দোলনে শরীক হওয়ার চেষ্টা করলেও মধ্য প্রদেশ এবং ছত্তিসগড়ে পার্শ্ব শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপোষণ এবং ঘুষের বাড়বাড়ন্ত তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও সন্দিহান করে তুলছে সাধারণ মানুষকে।
এদিকে মুখ্যমন্ত্রী কলেজের অস্থায়ী শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধি করলেও বিদ্যালয়ের পার্শ্ব শিক্ষকদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে তিনি সরে এসে তাঁদেরই বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কেন, সেটাই এখন প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গকে কালো টাকার মৃগয়াক্ষেত্র বানাবার জন্য ক্লাব এবং পুজো কমিটিগুলিকে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আর্থিক অনুদান দিতে দিতেই কি সরকারের পকেট ফাঁকা? তাই কি শিক্ষক পেটাতে নামানো হয়েছে পুলিশ?