কথায় বলে, বেনিয়া ততক্ষণ দরাজ, যতক্ষণ তার দর থাকে। শাসকের কাছে জনগণের অধিকার ব্যাপারটাও তেমনই। আর সে কারণেই, একটা প্রচণ্ড আঘাত যে আসতে চলেছে, ঘরে-বাইরে কারখানায়-অফিসে ক্ষেতে-বাজারে আমরা প্রত্যেকেই কার্যত প্রতিদিন তা টের পাচ্ছি। ‘জিএসটি’-‘নোটবন্দী’-‘আধার’-‘বিফ্-ব্যান’-‘অ্যান্টি-রোমিও-স্কোয়াড’ সব মিলিয়ে যে থমথমে দমবন্ধ পরিবেশ, তা যে বিশেষ কোনও ঘোর দুর্যোগেরই সংকেত, দিনে দিনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে; বিশেষ করে এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং দলিত-আদিবাসী মানুষের ওপর বর্তমানে সরকারে অধিষ্ঠিত বিজেপি-র আক্রমণের ঝাঁজটা যেভাবে উত্তরোত্তর বাড়ছে, আর তা চলছে ‘দলিত রাষ্ট্রপতি’-র উদার ব্যানারের নিচেই, তাতে একনিষ্ঠ হিন্দু অভিজাতরও মুখে কুলুপ এঁটে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। মুখে মুখে ফিরছে সরকারের ‘ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্ত’-এর কথা। রাজনৈতিক মহলে চলছে ফ্যাসিবিরোধী মহাজোটের জল্পনা। যদিও জনগণের জন্য রাখা আছে সাম্প্রদায়িকতা, পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী-নিয়ন্ত্রিত-রাজনীতির নানা ধরণের কম্বিনেশন নিয়ে তৈরি একাধিক পার্টির মধ্যে যে কোনও একটাকে বেছে নেওয়ার অবাধ গণতান্ত্রিক অধিকার, তাও আবার ‘শক্তির প্রতি ভক্তি’-র নীতি মেনেই। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথা !
‘ফ্যাসিবাদ’ কী? হিটলার-মুসলিনির মতো আঙুলের নির্দেশে লক্ষ্য-কোটি মানুষকে হত্যা করাই কি ফ্যাসিবাদ? এটা কি একটা উগ্র-জাতীয়তাবাদ? ফ্যাসিবাদ কি এক সম্প্রদায়ের ওপর অন্য সম্প্রদায়ের ঘৃণা? বিশেষভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী আগ্রাসনের আদর্শ কি ফ্যাসিবাদ? নাকি ফ্যাসিবাদ এক বিশেষ ধরণের সমাজতন্ত্র? (হিটলার-মুসলিনি উভয়েরই পার্টির নামেই তো ‘সমাজতন্ত্র’-এর উল্লেখ ছিল !) ফ্যাসিবাদের সাথে অর্থনীতির অবস্থার কোনও সম্পর্ক আছে কি? এই সমস্ত প্রশ্ন এবং তার ভিত্তিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানের বস্তুগত ও আদর্শগত উপাদানগুলির ব্যাখ্যা ব্যাতিরেকে না বোঝা সম্ভব আজকের বিজেপি সরকার ফ্যাসিবাদী কিনা, না আজকের ফ্যাসিবিরধী সংগ্রামের পথ খোঁজা সম্ভব।
জর্জি ডিমিট্রভ-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর ১৩ তম প্লেনামে ফ্যাসিবাদের একটি কম্প্যাক্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয় : “ফ্যাসিবাদের ক্ষমতায় আসা হল … ফিন্যান্স ক্যাপিটালের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে স্বজাতিমত্ত এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী উপাদানগুলির প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একাধিপত্য”। এই সংজ্ঞাটি সামগ্রিক বিচারে আমরা গ্রহণ করছি, কারণ এই ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা সম্ভব হয়েছিল, তার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি ও কৌশল ঠিক করবার ভিত্তিতে। এই সংজ্ঞাটি মূলগতভাবে যা তুলে ধরে তা হল, ফ্যাসিবাদের উত্থানের বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ফিন্যান্স ক্যাপিটালের কর্তৃত্বে অর্থনীতির অত্যন্ত গভীর সংকট থেকেই, আর আদর্শগত ভাবে সে জড়িয়ে ধরে সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বজাতিমত্ত মতধারাগুলিকে, এবং তৎপর হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বাধিয়ে অনেক অনেক দেশকে তার মধ্যে টেনে এনে তাদের জনগণের ওপর সংকটের বোঝা চাপিয়ে দিতে। ১৯৭০-এর দশক থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ ক্রমে ক্রমে নয়া-উদারবাদের পথে চলতে থাকার পর, সাম্প্রতিক ২০০৮ সালে প্রথম এই বিষয়টা সামনে আসে যে ওপরের সমস্ত চাকচিক্য সত্বেও ভেতরে ভেতরে এক গভীর সংকটে জরাজীর্ণ আজকের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। আমাদের দেশের বিজেপি সরকার ও ফ্যাসিবাদ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি বোঝবার জন্য আমাদের প্রাথমিক কাজ তাই আজকের নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সংকটের স্বরূপটিকে চিহ্নিত করা।
সাধারণ ভাবে নয়া-উদারবাদকে রাষ্ট্রনেতাদের বেছে নেওয়া একগুচ্ছ ‘উদারীকরণ’ পলিসি হিসাবে গণ্য করা হয়ে এসেছে : বেসরকারিকরণ, মিতব্যায়িতা, বিনিয়ন্ত্রণ ও মুক্ত বাণিজ্য-এর পলিসি হিসাবে…। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা সরকারগুলির বেছে নেওয়া পলিসি নয়, বরং এটাই আজকের পুঁজিবাদ। নয়া-উদারবাদকে ছেড়ে একটা পুঁজিবাদ আজ কল্পনাতেই থাকতে পারে, বাস্তবে নয়। এ হল আসলে পুঁজির সাম্রাজ্যবাদী পর্যায়ের আধুনিকতম দশা। প্রধান পাঁচটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে একে চিহ্নিত করা যায় : এক, ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স ক্যাপিটাল-এর কর্তৃত্বে ট্রান্স-ন্যাশনাল কোম্পানি গঠনের মধ্যে দিয়ে সমস্ত জাতিরাষ্ট্রে পুঁজির অবাধ গতি; দুই, দুনিয়াব্যাপী ‘বিনিয়োগ পিছু কর্মসংস্থান’-এর একই চিত্র (গুণগত ও সংখ্যাগত উভয় ভাবেই), পুঁজি বিনিয়োগ যতো বেশি, বিনিয়োগ পিছু কর্মসংস্থান ততো কম, এবং ফলে ‘ইনফরমাল সেক্টর’-এর ব্যাপক বিস্তার; তিন, শ্রমমূল্যের উদ্বৃত্ত ছোট বিনিয়োগ ক্ষেত্র থেকে বড় বিনিয়োগ ক্ষেত্রে, কৃষি থেকে শিল্পে, এবং এক মুদ্রা-অঞ্চল থেকে অন্য মুদ্রা-অঞ্চলে বিনিয়োগের পরিমাণ ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তিতে স্থানান্তর, ফলে অতিরিক্ত পুঁজি বিদেশে রপ্তানির সাথে সাথে উপড়ি-মুনাফা কামাবার লক্ষ্যে অন্যান্য দেশ থেকে নিজের দেশে পুঁজি টানবার দিকে ঝোঁক; চার, একসাথে প্রচুর পরিমানে কম দামী টেঁকসই পণ্যের উৎপাদনের বদলে তুলনায় কম পরিমানে বেশি দামী ঠুনকো পণ্যের বারবার নতুন রূপে উৎপাদন-এর দিকে কেন্দ্রীয় প্রবণতা; এবং পাঁচ, মজুত সামগ্রী নিয়ে ফাটকা কারবার থেকে ক্রমশঃ ভবিষ্যৎ উৎপাদন (যা এখনও উৎপাদিতই হয়নি) এবং তার বানিজ্য চুক্তিকে কেন্দ্র করে ফাটকা কারবারের (ডেরিভেটিভ ট্রেডিং-এর) প্রাধান্য।
একদিকে নতুন রূপে দামী পণ্যের উৎপাদন-এর দিকে কেন্দ্রীয় প্রবণতার ফলে জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দাম) বৃদ্ধির অপরিহার্য শর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে মুদ্রাস্ফীতি, ফলে জিডিপি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নেমে চলেছে; অন্যদিকে বারবার দামী পণ্যের উৎপাদন-এর সেই একই প্রবণতাই, যার উৎপাদন ও বাণিজ্য হবে, এখনও হয়নি, তার কন্ট্র্যাক্ট নিয়ে ফাটকার খেলায় মেতে স্টক (আসলে কাল্পনিক স্টক) বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে চলেছে বাস্তবের সীমানা পেরিয়ে। গোটা দুনিয়ার (আড়াই’শ-র বেশি দেশের) জিডিপি বৃদ্ধির গড় হার ১৯৬০-৭০-এর দশকে ৬% থেকে কমতে কমতে আজ কার্যত ২%-এ এসে পৌঁছেছে, আর এই পাঁচ দশকের মধ্যেই স্টক বিক্রির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে প্রায় ১০ গুণ। এ ফানুস এতটাই ফুলে উঠছে যে, এক একটা দেশের, বিশেষতঃ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর (যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান), ভবিষ্যৎ চ্যুক্তি-নির্ভর এই স্টক বিক্রির পরিমাণ তাদের জিডিপি-কেও ছাপিয়ে গেছে; ফলে তার পরেই (চ্যুক্তির মেয়াদ ফুরতেই) নেমে এসেছে সংকট। ’৭০-এর দশক থেকেই ব্রেটন উড ব্যবস্থার পতনের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য থেকে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড সরে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি মারফত নিজেদের মুদ্রা অন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সংকটও চালান করে দেয় এই দেশগুলো। ফলে বিশ্বায়িত পুঁজির সংকট উড়ে বেড়ায় এক সাম্রাজ্যবাদী দেশ থেকে অন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশে, শুধু যাত্রাপথে মাঝের অসংখ্য দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে দিয়ে যায়। দুঃখের কথা কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত চীনও এ মারণ-খেলায় ঢুকে পড়েছে। ১৯৯২-তে জাপান, ২০০০-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন, ২০০৮-এ এই তিন দেশ ও চীন, ২০১৬-তেও এরাই যদিও প্রধানত চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-এ কেন্দ্রীভূত হয়েছে এ সংকট; আর তার সাথে দেউলিয়া হয়ে গেছে কত কত দেশ ! উল্লেখ্য যে আমাদের দেশ ভারত, যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মার্কিনদের আর সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে, ২০১৬-এ এই দুই দেশের সংকট এসে জমা হয় এদেশে। কালো টাকা উদ্ধারের নামে নোটবন্দী করে জনগণের সমস্ত টাকা তুলে নিয়ে আর.বি.আই.-এর ‘মার্কেট স্টেবিলাইজেশন স্কিম’-এ তা ধরে রেখে এ সংকট থেকে বড় বড় পুঁজিপতিদের আপাতত রক্ষা করার মরিয়া চেষ্টা করে বর্তমান মোদী সরকার। যদিও গোটা দেশের অর্থনীতি এতে আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়।
আজ অবস্থাটা এমনই যে সেই সময়টা দরজার সামনে এসে গেছে যখন গোটা দুনিয়ার মোট স্টক বিক্রির পরিমাণ সাধারণভাবেই (শুধু স্টকের লাফ দিয়ে বেড়ে ওঠার ক্ষণেই নয়) পৃথিবীর মোট জিডিপি-কে ছাপিয়ে যাবে। এ সংকট কোন দেশ কোথায় আর চালান করবে? এই সংকটের বোঝা দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতেই আজ দেশে দেশে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে ফ্যাসিবাদ। আমাদের দেশ ব্যাতিক্রম হতে পারে না।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, আজকের ফ্যাসিবাদের রূপ অবিকল আগের মতো হবে না, হতে পারে না। তার প্রধান কারণ ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স ক্যাপিটাল-এর কর্তৃত্ব এবং ট্রান্স-ন্যাশনাল কোম্পানিগুলির স্বার্থ। এর জন্যই, প্রথমত, দুই সাম্রাজ্যবাদী দেশ পরস্পরের মধ্যে প্রত্যক্ষ জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ না করে করতে চাইবে পরোক্ষে ‘তৃতীয় স্থান’-এ যুদ্ধ, তা তৃতীয় বিশ্বের বা মাঝারি অর্থনীতির এক দেশে শাসক শ্রেণীর দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই হোক বা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে, সেখানে একে-এ-ওকে-ও স্পন্সর ক’রে; আর দ্বিতীয়ত, এক একটা জাতিকে সকলের চেয়ে উঁচু বলে প্রচারের চেয়ে (যা এর আগে ফ্যাসিবাদ করে এসেছে, যেমন নাৎসিবাদ) তাদের আজকের দুনিয়া ব্যাপী অভিন্ন এই আর্থিক সংকটের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ হল বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে খাটো করা, তার প্রতি সর্বত্র ঘৃণা ছড়ানো, যার জন্য তারা বেছে নিয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়কে, যার বলি হচ্ছেন এই সম্প্রদায়ের অগণিত নির্দোষ সাধারণ মানুষ। এই উদ্দেশ্যেই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের অজুহাত খাড়া করে তারা নিজেদের ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের দিকে জনগণের প্রাথমিক সমর্থন জোগাড়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে এই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের উৎসও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি নিজেই। এর অন্যতম ভিত ছিল তেলের একচেটিয়া মালিকানা। ফাটকা অর্থনীতির পরিনামে ১৯৭৪-এর প্রথম অয়েল শক-এর পর থেকে ১৯৮০-র গোটা দশকেই লাফ দিয়ে ওঠা তেলের একচেটিয়াগুলোর দাম আরব দেশগুলোয় বিশাল পরিমাণ পুঁজির সঞ্চয় ঘটায়, যার সমতুল্য ক্যাপিটাল আউটফ্লো হয়ে পৌঁছয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর দানবীয় ব্যাঙ্কগুলোতে। নয়া-উদারবাদের যুগে এই দেশগুলোরও নিজেদের দেশে পুঁজি টানবার ঝোঁক এতে প্রধানত কাজ করে। তেলের একচেটিয়া আর ফাটকা কারবারের দ্বন্দ্ব আখেরে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য যুদ্ধের রূপ পায়। একথাও আজ সবার জানা যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করবার জন্য মার্কিনীদের স্পেশাল ট্রেনিং-এ তৈরি কিছু সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ও তাদের নেতারাই ইসলামিক সন্ত্রাসবাদের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিল।
আজকের বিশ্বজনীন আর্থিক সংকট থেকে যে ফ্যাসিবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে, ভাবাদর্শগত দিক থেকে তার মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে দুনিয়া জুড়ে মুসলমান-বিদ্বেষ সৃষ্টি করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, “ফিন্যান্স ক্যাপিটালের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে স্বজাতিমত্ত এবং সবচেয়ে সাম্রাজ্যবাদী উপাদানগুলির প্রকাশ্য সন্ত্রাসবাদী একাধিপত্য” হিসাবে সকল প্রকার প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে পুরনো বস্তাপচা আদর্শগুলোকেই আঁকড়ে ধরে ফ্যাসিবাদ। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানের মধ্যে দিয়ে উদারচেতা মার্কিনী জনগণের মধ্যে আজ নতুন করে তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে ঘৃণ্য বর্ণ-বিদ্বেষ। প্রায় ১৬৫ বছর আগে কার্ল মার্কস ভারত সম্পর্কে বলেছিলেন : “স্বয়ং-বিকশিত একটি সমাজ-ব্যবস্থাকে তারা পরিণত করেছে অপরিবর্তমান প্রাকৃতিক নিয়তি রূপে এবং এই ভাবে আমদানি করেছে এমন পূজা যা পশু করে তোলে মানুষকে, প্রকৃতির উপর সার্বভৌম যে মানুষ, তাকে হনুমানদেব রূপী বানর এবং শবলাদেবী রূপী গরুর অর্চনায় পদানত করে অধঃপতনের প্রমাণ দিয়েছে”। আজ গোটা দেশ জুড়ে ‘গোমাতা’-র টি.আর.পি. তুলতে ‘বানরসেনা’-দের লম্ফঝম্প মার্কসের কথাগুলি আবার মনে করিয়ে দেয়; ফ্যাসিবাদ আজ ভারতের প্রাচীনতম নিকৃষ্ট জীবনাচারগুলোকেই মাটির তলা থেকে খুঁড়ে বার করে এনে পশু করে তুলছে মানুষকে।
নয়া-উদারবাদের মূল কথাই হল এক নবজাত ধনী ক্রেতা শ্রেণীর জন্য নিত্য-নতুন বিপুল দামী পণ্যের সমাহার, আর বিপরীতে সিংহভাগ মানুষের জন্য ‘মিতব্যয়িতা’। উদাহরণস্বরূপ, এদেশে সম্প্রতি লাগু হওয়া জিএসটি আসলে নয়া-উদারবাদের কর-ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছুই নয়। আগের বুর্জোয়া-ব্যবস্থায় কর ছিল ‘উৎপাদনের’ ওপর, আজকের জিএসটি হল ‘ভোগ’-এর ওপর কর। বাস্তবে জনগণের জন্য ‘আয়কর’ বদলে গেল ‘ব্যয়কর’-এ। নয়া-উদারবাদের এই যুগে বেশী আয়ের ওপর বর্ধিত হারে কর বর্তমান বুর্জোয়া রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নিতে পারে না, কারণ তাতে দামী পণ্যের চাহিদা কমে যাবে; তাই সেই সকল বিপুল সংখ্যক মানুষ যাঁদের আয় দারিদ্র্যসীমার নিচে বা আশপাশে, যাঁরা এতদিন ছিলেন কার্যত ‘আয়কর’-এর আওতার বাইরে, তাঁদের থেকেও ‘ব্যয়কর’ হিসাবে টাকা তুলে নিয়ে রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর ব্যবস্থাই হল এই জিএসটি। আজকের রাষ্ট্র মুষ্টিমেয় কিছু জায়মান অভিজাত শ্রেণী ব্যতীত সকল জনগণকে বলছে : “কর কমাতে চাইলে ব্যয় কমাও”। এই ‘মিতব্যয়িতা’-র অর্থনীতিরই সাংস্কৃতিক প্রচারের হাতিয়ার হল ভারতের বুকে ‘হিন্দুত্ব’ হিন্দু ধর্মের ‘মহান ত্যাগ’-এর বানী। ফলে ‘কৃচ্ছসাধন’-এর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মর্মবস্তুই হল ‘নয়া-উদারবাদ ও হিন্দুত্ব’-এর সম্মিলন বিজেপি।
কিন্তু দিনে দিনে নয়া-উদারবাদ বিশ্বব্যাপী যে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে ডুবে যাচ্ছে, তাতে ক্রমে ক্রমেই তার আর্থ-সাংস্কৃতিক মর্মবস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যা আগে দেখানো হয়েছে, ‘মুসলিম-বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ’। এদেশে প্রশ্নটা তাই আর কেবল ‘হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ’ থাকছে না, তার কেন্দ্রীয় প্রবণতা ক্রমেই রূপান্তরিত হচ্ছে, এবং দুনিয়া জুড়ে আর্থিক সংকটের পারদ চড়ার সাথে সাথে যা আরও ব্যপকতর হতে বাধ্য, ‘মুসলিম-বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ’-এ। হিন্দুত্বের প্রচারের থেকেও মুসলিম জনগণের প্রতি বিদ্বেষমূলক প্রচার ক্রমেই বেশি বেশি গুরুত্ব অর্জন করছে। অবশ্য একথা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে যে ফ্যাসিবাদ প্রতিক্রিয়াশীলতার কোনও রুপকেই, হিংসা ও ঘৃণা ছড়ানোয় কোনও কসুরই, কখনও ছাড়ে না।
বিজেপি-র জয়যাত্রার মাধ্যমে এদেশে ‘মুসলিম-বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ’-এর এই উত্থানের সময়, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রশ্নে, আজ দুটো বিষয় মনে রাখা খুবই জরুরী। এক, আজকের ফ্যাসিবাদ জন্ম নিচ্ছে নয়া-উদারবাদের সংকট থেকেই এবং এহেন সংকটগুলোতে, রক্ষণশীল ভাবে নয়, বরং তাকে আরও ব্যপক ও তীব্রভাবে প্রয়োগ করেই; আর কংগ্রেস সহ ভারতের প্রায় সমস্ত আঞ্চলিক রাজ্য-ভিত্তিক দলগুলিই প্রত্যক্ষ ভাবে নয়া-উদারবাদের পক্ষে, এবং আজকের বিজেপি-র উত্থানও তাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ থেকেই; তাই ফ্যাসি-বিরোধী জোটে দেশের জনগণ আজ কোনোভাবেই তাদের মেনে নেবেন না। এমন জোট কেবল বিজেপি-র আরও শক্তি বৃদ্ধিকেই ত্বরান্বিত করবে। আর দুই, এই সব কটি দল আসলে গভীর ভাবে ‘মুসলিম-বিদ্বেষী’, শুধু ভোটের স্বার্থে তাদের রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার ছাড়া তাদের কোনও অ্যাজেন্ডা কোনোদিন ছিলই না; যার প্রমাণ মেলে যখন দেখা যায় স্বাধীনতার ৭০ বছরে একজনও মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ না হয়েছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, না কাশ্মীর ব্যতীত একটি রাজ্যেও মুখ্যমন্ত্রী। আজকের ‘মুসলিম-বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদ’-এর উত্থানের প্রেক্ষিতে জোটের প্রশ্নে তাই এরা সাংস্কৃতিক প্রশ্নেও চূড়ান্ত দোদুল্যমান। তার সাথে রয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই চাপে পড়ে ভোল পাল্টানোর সুবিধাবাদী রাজনৈতিক অনুশীলন।
আজ বিজেপি-র মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ-এর উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান লাইন হতেই হবে ‘নয়া-উদারবাদ’-এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। সাধারণ ভাবে নয়া-উদারবাদ অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও বেকার যুবকদের পিষে মেরে চলছে। কিন্তু ফিন্যান্স ক্যাপিটালের এই সংকটের মুহূর্তগুলোতে বেসরকারি ক্ষেত্রে তুলনায় বেশি মজুরীর অবস্থাপন্ন শ্রমিকদের ওপরই ছাঁটাইয়ের কোপ পড়ছে সবচেয়ে বেশি ও সব চাইতে আগে; আর প্রবল শ্রমের বোঝা চাপছে ব্যাংক-কর্মীদের ঘাড়ে। তার সাথে এদেশে নয়া-উদারবাদ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কৃষি-অর্থনীতির, জমি লুঠ থেকে শুরু করে ফসলের নিচু দাম চাপিয়ে দিয়ে। মাঝারি ও ছোট সকল ব্যবসাকেও দিনে দিনে গিলে ফেলছে সে। ধর্ম নির্বিশেষে এই সকল অংশের জনজোটই পরিণত হতে পারে আজকের ‘ফ্যাসি-বিরোধী মহাজোট’-এ।
।। নয়া-উদারবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকল শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের জনজোট গড়ে তুলুন ।।
বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্ল্স্ ব্রিগেডের সদস্য।