“হিন্দু কহত হ্যায় রাম হামারা, মুসলমান রেহেমানা,
আপস মে দো লড়ে মারাত হ্যায়, মর্ম কই না জানা”

“আধি রোটি খায়েঙ্গে, পর মন্দির ওয়হি বানায়েঙ্গে”।… পথে ধর্মোন্মাদ ‘বানর সেনা’ আর রথে, আদতে রথের মত সাজানো শীততাপ নিয়ন্ত্রিত টয়োটা গাড়িতে, লালকৃষ্ণ আডবাণী। ১৯৯১ সালের আনন্দ পটবর্ধনের [ডকুমেন্টরি] ‘রাম কে নাম’ এগিয়ে চলে বাবরী মসজিদ ধংসের সত্য অনুসন্ধানে, পরিকল্পনা থেকে পরিণাম পর্যন্ত। রামের নাম নিতে গিয়ে কোথাও কি চাপা পড়ে গেছে ‘মানুষ’? আসলে সে কি চায়? ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’ না ‘বোলো, সিয়া অর রামচন্দ্র কি জয়’ ?
উত্তর রামায়ণে রামের প্রতি সীতার ক্ষোভ : “তুমি আমায় অযশের ভয়ে ত্যাগ করলে?”… সেই ক্ষোভকে উচিত শিক্ষা দিতে বিজয়া রাজে সিন্ধিয়ার মন্তব্য ছিল : “কোনও মেয়ে ইচ্ছানুসারে স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিতে চাইলে আমি বলার কে?”… আজকের উমা ভারতী, বসুন্ধরা রাজে-রা সেই ট্র্যাডিশানেরই উত্তরসূরি। এটাই রামরাজ্য।


“এত কিছু হয়ে গেল জনাব, আর এখন আপনারা এসছেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে? আজ এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে লোকে আমাদের সূরত অব্দি দেখতে চায় না”।… ‘রাম কে নাম’-এর সময় পেরিয়ে সাম্প্রতিককালে রাজস্থানে সঙ্গীত শিল্পী আহমেদ খানের খুন বা রোহিঙ্গা স্মরণার্থী অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের নঞর্থক মনভাব গেরুয়া শিবিরের মুসলিম বিদ্বেষের দ্যোতক হয়ে উঠেছে। ঢাকা পড়ে গেছে সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজের সেই অভিমান।
সেদিন শুধু ধর্ম বিদ্বেষ ছিল; আজ খাদ্যাভ্যাসও আক্রমণের অভিমুখ। ‘গরু’ শব্দটি আজ আতঙ্কের উদ্রেক ঘটায়। ২০১৫ সালে বাড়িতে গোমাংস রাখার ‘অভিযোগ’-এ উত্তর প্রদেশের দাদরী অঞ্চলে আখলাক নামের এক মুসলমান মানুষকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে খুন করে একদল ‘হিন্দুত্ববাদী’ দুষ্কৃতি। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছড়ায় চাঞ্চল্য। পরবর্তীকালে, উত্তর প্রদেশের বিধান সভা নির্বাচনের প্রচারে এসে বিজেপি নেতা অমিত শাহ্‌ এই ঘটনাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির করেন। কিন্তু ‘হাম্বা’ শব্দের হাঁসির রোল দেশের বুক থেকে হারিয়ে যাওয়ার কারণ কি? বর্তমানে কেরল, পশ্চিমবঙ্গ, অরুণাচল প্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা এবং সিকিমে গরু জবাই-এর উপর কোনও তো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিজেপি শাসিত বা এনডিএ জোটের সদস্য পার্টির দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলি গেরুয়া শিবিরের কট্টর অবস্থানের নিরিখে গরু জবাইয়ের প্রশ্নে ব্যাতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নইলে, এত আর্থিক বঞ্চনার পরেও সরকার টেকানোই যে দায়! পশু হত্যা রোধের প্রশ্নে রাজ্য সরকারগুলিকে দেওয়া সংবিধান প্রদত্ত অধিকারের বলে নাকি বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আইনত, ভারত থেকে গরু, মোষ বা ছাগলের হাড় ছাড়া মাংস রপ্তানির অধিকার রয়েছে। তাছাড়া, ভারতে গরুর চেয়ে মোষের মাংস খাওয়ার চলই বেশি। ২০১২ সালে, ভারত ৩.৬৪৩ মেট্রিক টন বিফ (যার মধ্যে গরুর থেকে মোষের মাংসের উপস্থিতিই বেশি) উৎপন্ন করে, যার মধ্যে ১.৬৮০ মেট্রিক টন রপ্তানি করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেবল গরুর উপর দরদ দেখিয়ে কেন পশুপ্রেমীকূল ক্ষান্ত হচ্ছে? আর রপ্তানিতে দোষ নেই, কেনই বা যত দোষ জবাইয়ে? প্রথমটার উত্তর হল, জনগণের ওপর চরম কর্তৃত্ব ফলানোর নিদর্শন হল মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ওপর রাষ্ট্রীয় হুকুমনামা জারি করা, যেখানে ‘গরু’-ই ‘বেস্ট চয়েস’ কারণ ‘গোমাতা’-র নামে রাজনীতি করাটা এদেশে সহজসাধ্য। দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে হলে কিছু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। ২০১৭ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ভারতীয় বাজারে জবাইয়ের জন্য পশু বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে, যা স্থগিত করে দেয় সুপ্রিম কোর্ট ব্যবসায় মার খেতে চলা চামড়ার ব্যাপারীদের কথা দর্শে। অন্যদিকে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ভারতের সবচেয়ে বড় বিফ এক্সপোর্ট কোম্পানি ‘আল কবীর’-এর মালিক হলেন সতীশ সাবরওয়াল, দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি ‘আরাবিয়ান এক্সপোর্টার’-এর মালিক সুনীল কপুর, তৃতীয় বৃহত্তম ‘এম কে আর এক্সপোর্ট’-এর মদন এবট। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ভারত বিশ্বের সর্ববৃহৎ বিফ রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে; ৩৫টির উপর দেশে বিফ রপ্তানি করা হয়। ফলে, জাতীয় ভক্ষণ কমিয়ে, দেশের মানুষের একাংশের খাদ্যাভ্যাসের ওপর কারফিউ জারি করে করে জবাই রোধের নামে ‘পশুপ্রেমীরা-ও-দেশপ্রেমী’-রা আসলে কাদের কোন স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে তা এ থেকেই স্পষ্ট।
“মেরা প্যায়ারা রামলালা”।… দেশের বি জে পি শাসিত রাজ্যগুলিতে শিশু মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে এগিয়ে যোগী আদিত্যনাথের সাম্রাজ্য যেখানে প্রতি হাজারে ৭৮টি ৫ বছর অনূর্ধ্ব শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এনএফএইচএস-এর রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে মধ্য প্রদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪টি ছয় বছর অনূর্ধ্ব শিশুর মৃত্যু হচ্ছে যা কিছু আফ্রিকার দেশের থেকেও পরিসংখ্যানগতভাবে পিছিয়ে পড়ার দ্যোতক। যখন পুষ্টি ও হাসপাতালে অক্সিজেন ও অন্যান্য পরিকাঠামোর অভাবে সদ্যোজাতের মৃত্যুর খবর বেড়েই চলেছে, তখন দুঃস্থ পরিবারগুলির মসীহা চিকিৎসক কাফিল খানকে পদচ্যুত করে যোগীর দাম্ভিক ধর্মবাণী : ‘শিশুদের পরিচর্যা কি সরকারের দায়িত্ব’?


“দেশদ্রোহীয়ো সাবধান, জাগ উঠা হ্যায় রাম ভাগওয়ান”।… ২০১৪-র নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায় বিজেপি-র অন্যতম আক্রমণ ছিল ‘দুর্নীতি’। দুর্নীতিতে ডুবে থাকা কংগ্রেসকে হঠিয়ে যাঁরা এলেন তাদের রোজনামচা একটু আলোচনা না করলেই নয়। এই ২৫ বছরে তাদের পকেট ভারী করার কাহিনীও প্রচুর। তাই কিছু সাম্প্রতিক কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ দুর্নীতির ছবি তুলে ধরা হল। প্রধানমন্ত্রীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সঞ্জীব রাজা এবং অনিল পরাশরের মত উত্তর প্রদেশের বিজেপি নেতারা ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত কিছু ‘দেশপ্রেমিক’ ডাক্তারদের উপর আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে ! সাম্প্রতিক গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে ৩৬,০০০ কোটি টাকার দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে ছত্তিসগড়ের বাহুবলী সি এম রমণ সিংহের। ‘ব্যাপম’ দুর্নীতির রেশ কাটতে না কাটতেই কর মুকুবের দাবীতে আন্দোলনরত কৃষকদের উপর গুলি চালিয়ে ন্যায়ের দাবীতে (সে কিসের ন্যায় তিনি নিজেই জানেন) অনশন করার ভান করতে হয়েছে মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীকে। তাছাড়া, এই অক্টোবরেই চুটকা পারমাণবিক কেন্দ্রের ক্ষতিকারক দিকের বিরুদ্ধে ৫৭৫টি গ্রামের কৃষকদের আন্দোলন তাঁর বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। ২০১৪-র ৪-জি স্পেকট্রাম অকশানে রিলায়েন্স জিও ইনফকমের প্রতি কেন্দ্র সরকার পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে ২২,৮৪৮ কোটি টাকার ক্ষতি মেনে নেয়! অমিত শাহ্‌-র ছেলে জয়ের আকস্মিক ব্যবসায়িক অগ্রগতির তথ্য ফাঁস হয়েছে সম্প্রতি। অন্যদিকে, সর্দার সরোবর বাঁধকে কেন্দ্র করে আন্দোলনরত মেধা পাটকরকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মুখ পুড়েছে মহারাষ্ট্র সরকারের। র‍্যাশন কার্ডের অভাবে ঝাড়খণ্ডের এক রিক্সাওয়ালার মৃত্যু কিংবা মোবাইলের আধার সংযুক্তির ফলে তথ্য ফাঁসের ঘটনা অস্বস্তিতে ফেলেছে গেরুয়া শিবিরকে। এ রাজ্যে শিশু পাচার কাণ্ডে রুদ্রাক্ষ শোভিতা রূপা ও রাজ্য বিজেপি-র মহিলা মোর্চার তৎকালীন সভানেত্রী জুহি চৌধুরীর সঙ্গে নাম জড়িয়েছে কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের। তাছাড়া, তৃণমূলের চিটফান্ড কাণ্ডের বিরুদ্ধে দেওয়া ‘ভাগ মুকুল ভাগ’ স্লোগান এখন পরিণত হয়েছে এই সঙ্গীতে : ‘দিনশেষে রাঙা মুকুল জাগল চিতে, সঙ্গোপনে ফুটবে প্রেমের মঞ্জরীতে’…।
“ম্যাঁয় ইয়াহা বন্দী হুঁ, মুঝে নিকালো”।… ১৯৪৯ সালে মহন্ত রামসেবক দাশকে রামলালার স্বপ্নাদেশ : বাবরি তে নাকি বন্দী রামলালা। সেদিনের স্বপ্নাদেশের যুগ পেরিয়ে আজ যেখানে পুরাণ বিশেষজ্ঞ দেবদত্ত পট্টনায়ক বেদ বা পুরাণের কাহিনীকে থেকে ‘তথ্য’ বলে প্রচারের বিপরীতে তার অন্তর্নিহিত ‘সত্য’-কে তুলে ধরতে উৎসাহী, সেখানে অমিশ ত্রিপাঠীর উপন্যাস সমগ্র ঘোষিতভাবে কল্পনা সাহিত্য হলেও তার প্রচার ও প্রভাবে নিহিত রয়েছে পুরাণের কাহিনীকে বাস্তব প্রমাণের মরিয়া প্রয়াস; এবং তা করতে গিয়ে, বলা ভালো, মেইন স্ট্রিম গেরুয়া মতধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে, প্রচলিত ধর্মসাহিত্যের বিকৃতি করতেও বাকি রাখেননি তিনি। তাঁর গল্পে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা হিসেবে সরস্বতী সভ্যতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। সরস্বতী সভ্যতার কেতাবি স্বীকৃতির জন্য বহুদিন ধরেই লড়াই চালাচ্ছে উগ্রহিন্দুত্ববাদী শিবির, এটা তারই সিকোয়েল। যেখানে গবেষণার মাধ্যমে সরস্বতী নদীর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নস্যাৎ করে ইরফান হাবিবের মত ইতিহাসবিদরা বলেছেন ‘এই নদী কোনদিন ছিলই না’, সেখানে তার আশেপাশে গজিয়ে ওঠা এক কাল্পনিক সভ্যতার গল্পের গরু গাছে উঠিয়ে এমনকি প্রাচীন বর্ণাশ্রমকেও গৌরবান্বিত করা হয়েছে। রামরাজ্যে শিশু জন্মাতেই নাকি তাকে বাবা মায়ের থেকে আলাদা করে বর্তমান গুজরাটের কাছে ‘মাইকা’ নামক এক জায়গায় তাদের ‘সমসুযোগের ভিত্তি’তে ‘মানুষ’ করে ‘রাষ্ট্র’ তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী বর্ণে ভাগ করে দিত ! প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, এত বানরসেনা তবে কি বাইরের দেশ থেকে এলো? আসলে, এ হল একদিকে ‘সমসুযোগ’-এর নামে শাসক শ্রেণীর বিপুল সম্পদের আদিম লুঠের ঘটনাগুলিকে খারিজ করার মরিয়া প্রয়াস, আর অন্যদিকে আজকের ‘ক্রেস’-ব্যবসার সুবিধা করে দিতে “এ তোমারই ইতিহাস” বলে প্রচার। সাম্প্রতিক প্রকাশিত বিকৃত রামায়ণের প্রথম খণ্ডে সমাজ বিকাশের ধারার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মাথা খেয়ে রাবণের লঙ্কাকে আদিম পুঁজিবাদী সমাজ দর্শানো হয়েছে এবং সীতার মুখ দিয়ে এও বলিয়ে নেওয়া হয়েছে যে গরীবরা বঞ্চনার ফলে অপরাধ প্রবণতার স্বীকার, তাই তাদের শাসন গ্রহণের বদলে তাদেরকেই শাসন করা উচিত! এই আজগুবি গল্পের সমালোচনা করে সময় নষ্টের কোনও দরকারই ছিল না যদি না এই নতুন ধারার কল্পনা সাহিত্যে ভর করে গেরুয়া বুদ্ধিজীবীরা স্বজাতিমত্ততায় মেতে উঠত। সাম্প্রতিক অসহিষ্ণুতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে দেশ জুড়ে বুদ্ধিজীবীদের সরকারি পুরষ্কার ত্যাগের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে অমিশ তার রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের পরিচয়ও দিয়ে ফেলেছেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে এই প্রবণতার বিরোধিতা করতে গিয়ে এক অন্য ধারার প্রতিক্রিয়ার স্বীকার হচ্ছে প্রগতিশীল মহল। উদাহরণস্বরূপ, গোবিন্দ পান্সারে ‘কে ছিলেন শিবাজি?’ বইতে মহারাষ্ট্রের মুসলিম বিদ্বেষের বিরোধিতা করতে গিয়ে (যার জন্য তাঁকে শিবসেনার হাতে খুন হতে হয়) শিবাজিকে এমন দেবত্বে উত্তীর্ণ করে ফেলেছিলেন যে যেন এই আদর্শ রাজার স্বর্গরাজ্যে শোষণ ব্যতীতই রাজ পরিবারের ঐ বৈভব সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল!


গেরুয়া অসহিষ্ণুতার দ্বিমুখী রূপ আজ জনমানসে সুপরিচিত। একদিকে যেমন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণের বদলে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বক্তৃতা সম্প্রচারে ব্রতী হয়েছে দূরদর্শন, অন্যদিকে তেমনই দাভোল্কর, পান্সারে এবং কাল্বরগির পর মুক্ত চিন্তা পিষে মারার লিস্টে নতুন সংযোজন গৌরী লঙ্কেশ।
‘রাম কে নাম’-এ বিতর্কিত রাম মন্দিরের সরকার নিযুক্ত পূজারি বলেছিলেন, “যেখানেই দেবমূর্তি বসাবেন সেখানেই মন্দির… এখানে ফকির রামজি-র মন্দির তো মুসলমান শাসকদের দ্বারা তৈরি; জানকী ঘাটের একাংশও তাই… বাবা রামচরণ দাস ও আমির আলির মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল যে হিন্দু ও মুসলিমরা একসাথে রইবে; এরা এসবেতে জল ঢেলে দিল… আজকের সাধুরা ভৌতিকবাদ বর্জন করে ত্যাগ তপস্যায় লীন? তারা পায় না হেঁটে প্লেনে চড়ে; এ সি-তে থাকে… দেশের ৯০% মানুষ ভুখা থাকবে, এটাই কি রামের আদর্শ?”… বাবরী মসজিদ ধ্বংস ছিল ভারতবর্ষে নয়া-উদারবাদের প্রবেশের সূচনা সম্মেলনের একটি অনুষ্ঠান মাত্র। দেশ যত বিশ্বায়িত ও বেসরকারিকরণের পথে হেঁটেছে, রাজনীতির ধর্ম-নির্ভরশীলতা ততই বেড়েছে। তথাকথিত পাকিস্তানি উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপের কারণ খুঁজতে গিয়ে তাই বলা হয়েছে ওগুলো নাকি ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির প্রতি ঈর্ষার ফসল। এই মতের উপর শিলমোহর দিতে গিয়ে মার্কিন বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞ রবার্ট কাপ্লান বলেছেন যে, বিশ্বায়নের যুগে ‘ভারতীয়’-রা তাদের হিন্দু ধর্মের ‘মুক্ত গণতন্ত্র’-কে গ্রহণ করেছে কিন্তু মুসলমানরা তা না পেরে মন দিয়েছে বিশ্ব ইসলামিক ভাতৃত্বে! এই ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ যে আসলে দেশের মুষ্টিমেয় অত-ধনীর জন্য বাকি সকল মানুষের জন্য, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে, কেবল ক্ষুধা-দারিদ্র্য-বেকারত্ব — এক কথায় ‘জীবন থেকে মুক্ত হওয়ার গণতন্ত্র’, তা আজ স্পষ্ট। আর সেজন্যই নয়া-উদারবাদের ‘কৃচ্ছসাধন’ আর হিন্দু ধর্মের ‘কৃচ্ছসাধন’-এর ধারা এসে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে বিজেপি-আরএসএস মোর্চায়।
আমাদের সংবিধান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিজেদের ধর্মীয় সত্তা বজায় রাখার অধিকার দিলেও আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ স্বীকৃত করেছে। আমাদের দেশের ধর্মস্থানগুলির বৈভব তাদের রক্ষণাবেক্ষণকারীদের কালে কালে মহাজনে পরিণত করতে শুরু করলে দানের অর্থের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আনতে ১৯২৫ সালে আসে গুরুদ্বারা আইন এবং ১৯৫৪-এ মসজিদ সংক্রান্ত ওয়ুফত আইন। গির্জাগুলি চলে আসে জাতীয় চার্চ কাউন্সিলের অধীনে। শুরুতে হিন্দুদের কোনও এরকম কেন্দ্রীয় সংস্থা না থাকায় অ্যানি বেসান্তের ধর্ম রক্ষা সভা মন্দিরের আর্থিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই লড়তে থাকে। দুর্নীতির নামে এই সংগ্রাম আসলে এই সমান্তরাল অর্থনীতির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পথ প্রশস্ত করে। ১৯৫১ সালে হিন্দু রেলিজিয়াস অ্যান্ড এন্ডাওমেন্ট পলিসি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে হিন্দু মন্দিরগুলির পরিচালন সমিতিতে পুরোহিত ও সেবাইতদের সঙ্গে সরকারি আমলা ও আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের (কর্পোরেট অনুপ্রবেশের প্রশস্ত পথ) অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। এই সরকার-মন্দির-কর্পোরেট ত্রিকোণই আজকের নয়াউদারবাদী ফাটকা কারবারের ধর্মীয় ভিত্তি। মন্দিরের জমি কেনা এবং সেখানে রিয়াল এস্টেটের ব্যবসা মন্দির কতৃপক্ষ ও কর্পোরেটদের স্বার্থকে মিলিয়ে দিয়েছে। ফলে তীর্থযাত্রা, বেসরকারি ধর্মীয় সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয় বা মঠের নিজস্ব পণ্য বিক্রি — প্রতিটা ক্ষেত্রেই আজ কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি বদান্যতায়। ২০০১ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশান বৈদিক বিজ্ঞান ও জ্যোতিষ শাস্ত্রকে পাঠ্যক্রমভুক্ত করায় শীলমোহর দেয়। অন্যদিকে, খুন বা ধর্ষণের মত গুরুতর অভিযোগের পরেও শাস্তি দিতে বিলম্ব হয়েছে বা দেওয়াই হয়নি আশারাম বাপু, নিত্যানন্দ, সন্ত রামপাল প্রভৃতির ক্ষেত্রে। বর্তমানে রামদেবের ৪০০০ কোটি টাকার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে উত্তরাখণ্ড ও মধ্য প্রদেশ সরকার এবং বেদান্ত গ্রুপের অনিল আগরওয়াল, লক্ষ্মী মিত্তাল ও হিন্দুজা ব্রাদার্স। তাঁর প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত আয়ুর্বেদিক পণ্যের বিলাসবহুল সম্প্রচার জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। মাঝে মাঝে তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রোডাক্টের বিরুদ্ধে সরকারি লাইসেন্স না থাকার অভিযোগ ওঠে। সাম্প্রতিক তাঁদের আমলা রস বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায়! অন্যদিকে, কুখ্যাত বাবা রামরহিমকে ১.১২ কোটি টাকার সরকারি অনুদান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে হরিয়ানার ৩ সরকারি মন্ত্রীর বিরুদ্ধে। স্বঘোষিত ধর্মগুরুদের দাপটও একাহারে বেড়েছে।
‘ওয়ে (মুলায়ামের উদ্দেশ্যে) সাচ্চে ইয়াদব নাহি হ্যায়! জারুর কিসি নিচি জাতি কা হোগা জো আডবাণী জি কা রথ রোকনে কি প্রয়াস করে’… আনন্দ পটবর্ধন শুনিয়েছিলেন গোমতী নগরের ভাবনাদেবীর কথা : ‘হাম তো নীচ জাতি কে লোগ হ্যায়… মান্দির কে বাহার সে হি ভাগওয়ান কো নমঃস্কার করনা পড়তা হ্যায়… মান্দির হো ইয়া মাসজিদ, হামকো ক্যা ফারাক পারেগা?’… রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা এবং ২০১৬-র সাহারানপুর উন্মত্ততা রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি বানানোর আড়ালে আসলে বিজেপি-র এই দলিত বিদ্বেষকেই ফুটিয়ে তোলে।
তথ্যচিত্রে দেখানো অপসারিত ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের চোখের জলে লুকিয়ে আছে রাম নাম অঙ্কিত ইট বা পাথর সংক্রান্ত আর্থিক তছরুপের কাহিনী।… আজ বহু বিদেশি বেসরকারি উদ্যোগ এবং মার্কিন কর মুক্ত চ্যারিটি সংস্থা বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সংঘের আর্থিক মদতদাতা হিসেবে কাজ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিন্দু স্বয়মসেবক সংঘ এবং আমেরিকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বছরে যথাক্রমে ১.৪ এবং ১ বিলিয়ন অনুদান পাঠায় ভারতে। একল এবং বিবেক ফাইন্ডেশান দুঃস্থ ভারতীয় শিশুদের আর্থিক সাহায্যের নাম করে যথাক্রমে ১৪ এবং ১১ বিলিয়ন টাকার অনুদান পাঠায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে প্রতি বছর।
“ইয়ে তো পেহেলে ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মাথুরা বাকি হ্যায়”।… হ্যাঁ, সত্যিই বাকি ছিল। গোধরার গণহত্যা চোখ খুলে দিল। ‘ফিরাক’ দেখালো কিভাবে ‘বাচ্চা বাচ্চা রাম কা’ তাদের অভীষ্টের দিকে আরও এগিয়ে গেছে। এর পরেও যারা ‘বিজেপি আর অচ্ছুত নয়’ বলে এনডিএ-তে যোগ দিল তাদের মধ্যে শামিল মমতা আজ দাঙ্গা বিরোধী গাল পাড়লেও পশ্চিমবঙ্গের শেষ ৫ বছরের প্রতিটি দাঙ্গায় তার দলের যোগ দেখা গেছে। কংগ্রেসের শিখ হত্যার কাহিনী তো সুবিদিতই। আর নিতিশ কুমারের মত পাল্টিবাজ সোশ্যালিস্টদেরও আজ নিজের লোকেদের কাছে শুনতে হচ্ছে : ‘গদ্দার’।
অতঃপর ?

তথ্য সূত্র :
১। রাম কে নাম (তথ্যচিত্র)- আনন্দ পটবর্ধন
২। বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা- সুকুমারী ভট্টাচার্য
৩। জ্যোতিষের রাজনীতি- দেবব্রত রপ্তান
৪। হারভেস্ট অফ হেট- স্বামী অগ্নিবেশ ও বালসন থাম্পু
৫। ইন দ্য বেলি অফ দ্য বিস্ট- পার্থ ব্যানার্জী
৬। সরস্বতী নদী কল্পনা ও বাস্তবে- ইরফান হাবিব
৭। দ্য গড মার্কেট- মীরা নন্দ

সুমিত ঘোষ পিপ্‌ল্‌স্‌ ব্রিগেডের সদস্য। 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *