মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। জন্ম ১৮৮৯-র ৫ আগষ্ট। বাঙলার ১২৯৬-র ২১ শ্রাবণ সোমবার। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাগণের এক অন্যতম ব্যক্তিত্ব । তাঁকে আমি প্রথম দেখেছি নিমতায়। সত্যেন পল্লিতে থাকেন নীলকৃষ্ণ পাল। তিনি ছিলেন কলকাতার ট্রাম কোম্পানিতে কাজ করা একজন শ্রমিক। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়িতে আয়োজন করা হয়েছিল এক সাধারণ সভা। এই ধরণের সভায় সাধারণ মানুষের যোগদানের সুযোগ থাকে না। আজও নেই। এ-সভা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সদস্যদের সভা। বেশি যা , তা হল পার্টির সভ্য হবার যোগ্যতা রাখেন এমন ঘনিষ্ঠরা এ-সভায় অংশ নেবার আমন্ত্রণ পেতেন। আমি এই বর্ধিত অংশের যোগ্যতা নিয়ে এই সভায় উপস্থিত হবার সুযোগ পেয়ে ছিলাম। এই সভার মূল আলোচক ছিলেন , কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। 

যাঁদের দৌলতে এই সভায় আমার যোগদানের যোগ্যতা হয়ে ছিল তাঁরা ছিলেন, নিমতা আলিপুরের নেতা কমরেড অসিত রঞ্জন ঘোষ। এলাকায় যিনি ‘কর্তা’ নামে পরিচিত। ছিলেন কমরেড জ্যোতির্ময় রায়। এলাকায় যিনি পরিচিত ছিলেন ‘খুকু বাবু’ নামে । আর ছিলেন কমরেড বিশ্বনাথ পাল। যিনি আমাকে কমিউনিস্ট পার্টির কাছে যাবার সুযোগ করে দিয়েছেন। তিন জনের কাজের পরিধি প্রাথমিক ভাবে ছিল জনকল্যাণ উদয়পুর কলাবাগান আর আলিপুর নিয়ে যে অঞ্চল । আমাদের মূল নেতা ছিলেন অসিত রঞ্জন ঘোষ।

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর সঙ্গে আমার একটা মানসিক নৈকট্য তৈরি হয়ে ছিল প্রথম থেকেই। কেমন করে। বিষয়টার হদিশ মিলবে, মানব মনের জটিল তত্ত্বের গভীরে সন্ধান করলে। দূরের মানুষ কেমন করে কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন এ এক মিষ্টি রহস্য। স্থান কাল ব্যক্তি। জীবিকা ধর্ম-ভাবনা দর্শন এ-গুলো মানুষে মানুষে যোজকের কাজ করে। যেখানে রক্তের সম্পর্ক থাকে না। যেমন আমার বেলায় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর জন্ম স্থান , তাঁর কথায়–’চট্টগ্রাম হতে বরিশাল পর্যন্ত মেঘনার মোহনা বিস্তৃত। এই মোহনায় সাগরে ভাসমান একটি ছোট্ট দ্বীপের নাম সন্দ্বীপ। হাজার বছর আগে এই দ্বীপে মানুষের বসতি ছিল। সন্দ্বীপ বাদশাহী আমলের একটি পরগনা। নোয়াখালী জেলার স্থলভাগের বামনী প্রভৃতি জায়গা সন্দ্বীপ পরগনায় অবস্থিত। প্রশাসনিক ব্যাপারে দ্বীপটি আগে নোয়াখালী জিলায় ছিল’।

নোয়াখালী জেলায় আমার মামার বাড়ি। এখানে স্থানসূত্র ক্রিয়াশীল। তিনি সমাজ বদলে বিশ্বাসী। আমি সদ্য সেই বিশ্বাসের দুয়ারে প্রবেশে অপেক্ষমান আগ্রহী। তিনি প্রাজ্ঞ একজন মার্ক্সবাদী। আমি মার্কসবাদী হবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। ভাবাদর্শ এখানে যোজকের কাজ করছে। 

এ ছাড়া সমাজে যাঁরা দুঃসাহসিক কাজ করেন, তাঁরা বালক কিশোর বা তরুণ মনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেন। নবীন মন কল্পনায় ঐ মানুষদের আড়ে-দিঘে অনেক বড় করে দেখে। এবং অপরকে দেখাতে চায়। এর থেকে তয়ের হয় নানা কিংবদন্তী । আমার ঐ বয়সে আমি যখন দেখি, আমার সামনে বসে আছেন, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার দ্বীপান্তরের সাজা পাওয়া আসামি, তখন যেন নিজেকেই বিশ্বাস করতে সংশয় হয়। কল্পনার সঙ্গে কোন মিল নেই, সামনে বসে থাকা ছোট খাটো সাদাসিধা মৃদুভাষী মানুষটির। 

দূরত্বের শেষ ফাঁকটুকু মিলিয়ে গেল, যখন দেখলাম, ‘কর্তা’ (আমাদের নেতা) উঠে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ জুড়লেন। শোনা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে দু’জনের আলাপচারিতা। এই ছিল কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদকে আমার প্রথম দেখার অভিজ্ঞতা।  

সব চেয়ে মজার কথা, বিস্ময়ের আবেগে সেই মুহূর্তে এতটাই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, মৃদু উচ্চারণে তাঁর বক্তব্য বিষয়ের অনেক কিছুই আমার শ্রবণের বাইরে থেকে গেল। অনেক কাল পরে সে দিনের কথা মনে করে লজ্জিত হয়েছি। আবার বিস্ময়বোধ করেছি এই ভেবে , এতটা নিচু গলায় কথা বলে এত মানুষকে এঁরা বশে আনেন কোন কৌশলে। এমনই আর এক জনকে প্রত্যক্ষ করে ছিলুম, তিনি ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। প্রার্থনা সভায় শুনেছি তাঁর কন্ঠস্বর । সে-ও এমনই মৃদু। শান্ত। 

অথচ আমাদের চলতি অভিজ্ঞতা হল, নেতাগণের উচ্চ কণ্ঠ, সঙ্গে মঞ্চে দাপিয়ে বেড়ানো। বঙ্কিম চন্দ্রের কোনও লেখায় পড়ে ছিলাম গলার জোরের সুখ্যাতি। যা ছিল পার্লামেন্টিয় রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তিনি লিখছেন, ‘গ্ল্যাডস্টোন হইতে ডিসরেলি সকলেই জিতিয়া গেল এক মাত্র গলার জোরেই’। এঁরা ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নাম করা সদস্য। এর পর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-কে এত কাছ থেকে আর কোন দিন দেখবার সুযোগ ঘটে নি। আবার কোন ময়দানে মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেও দেখিনি।  

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর কথা বলতে গেলে অনেক সংযত হয়ে বলতে হয়। কারণ তিনি ছিলেন সাধারণের থেকে আলাদা প্রকৃতির মানুষ। শুনেছি, তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল ব্যতিক্রমী। তা-ও নিজের আত্মকথা লিখবার সময় লিখছেন, ‘ দলীলের সাহায্যে স্মৃতিকে সতেজ না করে আমি কিছুতেই আমার স্মৃতিকথা লিখতে চাই না ’। অথচ আমরা কত কথাই না বলি , যেখানে আবেগের পীড়নে সত্য আত্মগোপন করে থাকে। কখনও বা তার মৃত্যুই ঘটিয়ে ফেলি।  

তিনি লিখতেন ধীরে। হস্তাক্ষর ছিল স্পষ্ট। হাতের লেখা নিয়ে তিনি বলতেন, লেখা স্পষ্ট করে লিখতে হয়, কারণ লেখা ছাপার জন্য যাঁরা কম্পোজ করেন, তাঁরা অধিকাংশই বেশি পড়া-লেখা করা মানুষ ন’ন। কাজেই তাঁদের বুঝতে যেন অসুবিধা না হয়,  কথাটা খেয়াল রেখে লেখা উচিত। এমন কথা আমি আর কোন লেখকের জবানিতে শুনিনি। 

তাঁর রচনায় লক্ষ করেছি, রূপান্তর না ঘটিয়ে আহরিত বিদেশী শব্দের ব্যবহার। এবং মূল ধ্বনির সঙ্গে বাংলা হরফের সাযুজ্য রেখে প্রকাশ করা। সঙ্গে আছে আরবী ফার্সী শব্দের বহুল ব্যবহার। কিছু নমুনা — তাকিদ, পুস্তক, তৈয়ার, সনাখৎ করণ, নিবেন, খোলাসা, মুখ্‌তারী, কুর্‌আন, ক’ছত্র ( কয়েক লাইন ), গিরেফ্‌তার, ইলাকা, ইশ্‌তিহার, ওর্ফে ইত্যাদি। এই সকল শব্দের ব্যবহারে আমার ধারণা, রচনায় একটা আলাদা মাধুর্য যোগ হয়েছে। তাঁর রচনা দ্রুত পড়বার নয়। দ্রুত পড়া যায় না। তাঁর নিজের লেখার গতির সঙ্গে পাঠকের পড়বার গতির একটা মিল তয়ের হয়ে যায়। 

‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ বইখানা আমার পড়া  মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ -এর প্রথম রচনা। পড়ে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম মনে আছে। নজরুল-এর সম্পর্কে এত বিস্তারিত আগে জানতাম না। যেমন তথ্য তেমন রচনা শৈলী। খুব ভালো লেগে ছিল। পরের বই “আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি”। পড়লুম, যখন রাজনৈতিক কোন দলের সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বইখানা ভালো লাগার এক কারণ মনে হয়, মানুষ যে কারণে স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালোবাসে। যে পথ ধরে একদিন দল বেঁধে হেঁটেছি, সে-পথের অনেক কাহিনি চলার বেগে তখন অগোচরে রয়ে গিয়েছিল।অনুভূতি অনেকটা এই রকমের, যেন হারিয়ে যাওয়া জিনিস খুঁজতে খুঁজতে ফেলে আসা পথে ফিরে হাঁটা। গতি শ্লথ। নজর তীক্ষ্ণ। যাকে হারানো গেল তাকে না পেলেও অনেক নতুন পাওয়ার এক আরামদায়ক অনুভূতি। 

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ  ছিলেন ভারতে মার্ক্সবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে অগ্রণীদের মধ্যে অন্যতম। ব্রিটিশ-ভারতের আফগানিস্থান থেকে বাঙলা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, যেখানেই রাজ শক্তির বিরুদ্ধে দ্রোহী বা বিপ্লবী অথবা সন্ত্রাসীদের খবর পেয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছেন। ভারতের বাইরের কথা না ধরেও বলা যায়, অবিশ্বাস্য। আত্মস্মৃতি যখন লিখছেন তখন তাঁর বয়স আশি বছর। এত ঘটনাবহুল জীবন। এত বিচিত্র মানুষের সঙ্গ। স্মরণ করে প্রত্যেকের কথা লিখেছেন। ভাবলে বিস্ময় জাগে। 

রাজদ্রোহী বিপ্লবী সন্ত্রাসী ফেরারী আত্মগোপনকারী ইত্যাদি শব্দগুলো মননে উচ্চারিত হলেই সংস্কার বশে কাল্পনিক যে কায়া দর্শনে আমরা অভ্যস্ত, সে মূর্তি মুহূর্তে মিলিয়ে যায়, যে মুহূর্তে তিনি সম্মুখে উপস্থিত হ’ন। বিশ্বাস হতে চায় না, মৃদুভাষী ছোট খাটো আকারের এই মানুষটি এই বিশাল কর্মকান্ডের পুরোহিত।

 

মতাদর্শের প্রচারের ক্ষেত্রে তিনি সব চেয়ে জোর দিতেন পত্রিকা প্রকাশে। নিজে অনেক পত্রিকা প্রকাশ করেছেন বা পত্রিকা প্রকাশে উৎসাহ দিয়েছেন। ছাত্র অবস্থায় প্রবন্ধ রচনা করে পাঠিয়ে ছিলেন, সে সময়ের বিখ্যাত সাময়িক পত্রিকা ‘প্রবাসী’-তে। যার সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। রচনার বিষয়, তাঁর জন্মস্থান সন্দ্বীপ অঞ্চলে সাধারণের ব্যবহার করা এক জ্বালানি তেল। যা স্থানীয় গাছের বীজ থেকে নিষ্কাষণ করে সংগ্রহ করা হত। প্রবন্ধের বিষয় ছিল উক্ত তেলের বাণিজ্যিকরণের সম্ভাবনা নিয়ে। অজ্ঞাত কিশোরের রচনা ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে ছিল। 

আমার নিজের আর একটি অভিজ্ঞতার কথা, আমাদের এলাকা উদয়পুরে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। উদ্যোক্তা নাগরিক সমিতি। আমাদের ইচ্ছা উৎপল দত্ত-র একটি নাটক। উনি তখন মঞ্চশয্যা ছাড়াই ছোট নাটক করছেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া কঠিন। একখানা সুপারিশ সংগ্রহ করা গেল। সে-টি লিখে ছিলেন , মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। সে সুপারিশ যখন তাঁর কাছে পৌঁছল, তিনি মন্তব্য করে ছিলেন, যেখান থেকে এ চিঠি এনেছেন, তাঁর আদেশ অমান্য করা যায় না। উৎপল দত্ত এলেন। তাঁর ছোট দল নিয়ে ছোট নাটক অভিনয় করলেন। এলাকার মানুষ উপভোগ করলেন, বন ফুলের লেখা ছোট গল্প অবলম্বনে রচনা এক মজাদার নাটক ‘সদগোপ’। 

মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ-এর প্রতি তাঁর এই শ্রদ্ধা সম্পর্কে যা শুনেছি, তা হল, এই ইংরাজি নাটক করা সাহেবকে বাংলা নাটক করবার অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। আর বাংলা পেল, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার পরিচালক এবং অভিনেতা উৎপল দত্তকে। ঘটনা অদ্ভুত ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় এমনই আর একটি ঘটনার কথা। সময় ঊনবিংশ শতাব্দী। পাত্রগণ মধুসূদন এবং বিদ্যসাগর। ইতিহাস কি এমনি করেই বর্তমানকে কর্তব্য নির্দেশ করে দেয়। 

মুজফ্‌ফর-এর কোন রচনা পাঠ করে আমি মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী হই নি। তাঁর এমন কোন রচনা আছে বলে আমার জানা নেই। সামাজিক কাজ করতে করতে মার্কসবাদে বিশ্বাসী অগ্রজদের সান্নিধ্য এ-বিষয়ে বেশি কাজ করেছে। তবে শুরুর দিকেই আমি তাঁকে প্রত্যক্ষ করেছি। আমার জীবনে এটা এক বিশেষ ঘটনা বলেই আমি মনে করি । 

 

 

 

 

 

বিমল কান্তি দাশ গুপ্ত একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং চিত্রশিল্পী। 

 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *