২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র উত্থান যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিবর্তন ঘটিয়েছে, গো-রক্ষকদের দাপাদাপি থেকে প্রকাশ্য ‘ইসলাম বিদ্বেষ’, সংখ্যালঘু নিপীড়ন থেকে উগ্র সমরবাদ, নোটবন্দী থেকে জিএসটি মারফৎ, গত সাড়ে তিন বছরে তা সম্পূর্ণ স্পষ্ট এবং স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা, সরকারি মাইনের অধ্যাপকেরা এবং মিডিয়ামুখী তাত্ত্বিকদের এক বিরাট অংশ, যাঁরা বিজেপি’র এই ক্ষমতায়নকে দেখছেন এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক উত্থান হিসেবে এবং কর্তৃত্ববাদী বিজেপি-রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংস্বেবক সঙ্ঘের ফ্যাসিবাদী আদর্শের প্রেক্ষাপটে বিপর্যস্ত সমাজজীবনের ‘নয়া পথ’ হিসেবে বাতলাচ্ছেন ‘বিরোধী ঐক্য’-র লাইন, পথে ঘাটে না হলেও, অন্তত মিডিয়ার লিখিত ও দৃশ্যত উভয় ভার্সনেই তাকে কেন্দ্র করে টি.আর.পি’র পারদ চড়ছে বৈকি!
এযাবৎ কাল গণমাধ্যম তা সে লিখিত হোক বা দৃশ্যত, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হলেও (রাষ্ট্রের ‘ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাস’ হিসেবে কাজ করে), নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়নের যুগে কর্পোরেট মিডিয়া নিজেই এমনকি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে – মিডিয়া হাউসগুলোর শেয়ারের উঠিতি বাজারে, তথ্যের বিশ্বায়ন ও তাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যত নির্ভর ফাটকাবাজির এই যুগে যা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক! তাই ‘বাম-কংগ্রেস জোট’ হোক বা ‘বিজেপি-বিরোধী মহাজোট,’ সব ক্ষেত্রেই কোথাও (যেমন এরাজ্যে) ‘তৃণমূল বনাম বাকীরা’ আর কোথাও ‘বিজেপি বনাম বাকী সবাই’ – এই প্রচার মারফৎ মিডিয়াগুলো ঘুলিয়ে দিতে চায় শ্রেণী-সংগ্রামের মৌলিক প্রশ্নকে, এবং পরিকল্পিতভাবে ক্ষতি করতে চায় শ্রমিক শ্রেণীর রাজনৈতিক আন্দোলনকে, কমিউনিষ্ট পার্টিগুলোকে বিপথে চালনা করার লক্ষ্য নিয়ে, শ্রেণীসংগ্রামের স্থানে সংসদীয় সংগ্রামকে প্রতিস্থাপিত ক’রে তারা কুড়িয়ে নেয় বুর্জোয়াদের মহার্ঘ্যভাতা।
সমস্যার জায়গাটা এখানেই যে, মিডিয়া ও রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিদের ‘বিরোধী-ঐক্য’-এর দাবীতে সরব কাকুতির মধ্যে যুক্তির ঘ্রাণ পেয়ে, সে দাবীর পক্ষে দক্ষিণপন্থী, উদারপন্থী এবং সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা জোরদার সওয়াল করলে, সংসদের আসন ও শাসনের প্রতি তাঁদের লোভাতুর প্রবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতে তা যতটা স্বাভাবিক ঠেকে, ঠিক ততটাই অবাক লাগে যখন এমনকি বামপন্থী ও কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃত্বও এহেন ‘ঐক্য’-র প্রশ্নে ‘ঐক্যবদ্ধ’ হতে চেয়ে, বিজেপি-বিরোধীতার নামে ‘নির্বাচনী-সঙ্গম’-এ আলিঙ্গন করেন দেশের রাজনৈতিক পাপাচারের কুড়াদান থেকে উঠে আসা সমস্ত আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলিকে, তাদের ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্রের দোহাই টেনে এবং এহেন ‘বিরোধী ঐক্য’-র নেতৃত্বের স্থানে আহ্বান জানান এসকল সমাজবিরোধী নিয়ন্ত্রিত দলের ‘ঔরসদাতা রাজনৈতিক পিতা’ ‘ভারতের জাতীয় কংগ্রেস’-কে, যার সাথে ‘নির্বাচনী আঁতাত’-এর পরিনামে স্বাধীনতার পর বাংলায় প্রথম বারের জন্য সরকার গঠন তো দূরঅস্ত, এমনকি প্রধান বিরোধী পক্ষের তকমাও হারিয়েছেন বামেরা।
উগ্র-হিন্দুত্ববাদী আরএসএস’-এর রাজনৈতিক ‘উইং’ বিজেপি যে একটি বর্বর রাজনৈতিক শক্তি তা নিয়ে দ্বিমতের জায়গা নেই এবং তা নেই কেবলমাত্র তার ‘হিন্দুত্ববাদী’ আগ্রাসনের জন্যই নয়, বরং এমনকি চরম কর্তৃত্ববাদী অর্থনৈতিক নিষ্পেষন চাপিয়ে দেওয়ার জন্য, নয়া-উদারবাদের যুগে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ফিনান্স পুঁজির উগ্র কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য – বিমুদ্রায়ন ও জিএসটি যার জ্বলন্ত উদাহরণ। বিজেপি ও তার দোসর আরএসএস-এর রাজনীতির এই জোড়া বিপদের সামনে, কার্যত ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বামেরা যখন কংগ্রেস সহ সমস্ত আঞ্চলিক দলের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার লাইন নামাচ্ছেন ‘কর্তৃত্ববাদী সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতিকে রুখতে, ঠিক তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমারা খোলসা করে দিতে চাই যে, কংগ্রেস সহ এই আঞ্চলিক দলগুলোর অগণতান্ত্রিক, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন-ব্যবস্থাই কিভাবে জনগণকে চিরতার জলের মতো বিজেপি-র এই ‘কর্তৃত্ববাদী সাম্প্রদায়িক’ রাজনীতিকে গিলতে হচ্ছে।

।। ১ ।।

‘পরিবারতন্ত্র’! কি সামাজিক কীই বা রাজনৈতিক, ভারতবর্ষের ভূখা-নাঙ্গা মেহনতী জনতাকে ঐতিহাসিকভাবে শোষনের জাঁতাকলে পিষেছে পরিবারতান্ত্রিকতা। একদম রাজতন্ত্রের যুগের পরিবারকেন্দ্রিক রাজ্যাভিষেক থেকে শুরু করে, সামন্ততন্ত্রের আমলের জমিদারী প্রথা সমস্তটাই মেহনতী জনগণের উপর মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের ‘শোষন’-এর একচেটিয়া অধিকারের ইতিহাস। আমাদের দেশের কাস্ট প্রথা যা প্রাচীন বর্ণাশ্রম প্রথারই আধুনিক ভার্সন, তা-ও টিঁকে আছে পরিবারের উপর, বংশানুক্রমিক আর্থ-সামাজিক কর্তৃত্বের ধর্মীয়-সামাজিক পন্থা ছাড়া তা আর কিছুই নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজকের দিনে রাষ্ট্রের ইডিওলজিকাল অ্যাপারেটাস হিসেবে ছোট-পর্দার মেগা সিরিয়ালগুলোতেও যে সমস্ত গল্প দেখানো হয়, ইচ্ছাকৃত ভাবেই সেগুলোর সিংহভাগই ‘পারিবারিক মূল্যবোধ’-এর প্রচার মারফৎ এই পরিবারকেন্দ্রিক শোষনের দর্শন জিইয়ে রাখতে চায় আমাদের মনে, যার চরম রূপ প্রকাশ পায় যখন জনপ্রিয় পরিবারতান্ত্রিক সিরিয়ালের নায়িকা আচমকাই ব’নে যান দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী! প্রাচীনকালের এই পরিবারতান্ত্রিকতা ও তৎকেন্দ্রিক শোষনের উত্তরাধিকার হিসেবেই আমাদের দেশের প্রধান দুই বৃহৎ বুর্জোয়া দল ‘জাতীয় কংগ্রেস’ ও ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ সর্বতোভাবে পরিবারতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে গ্রহন করেছে যথাক্রমে ‘নেহেরু-গান্ধী পরিবার’ ও ‘সঙ্ঘ-পরিবার’-এর নামে।
দেশী-বিদেশী বৃহৎ পুঁজিপতি-জমিদারদের বিশ্বস্ত এই দুই প্রধান দল ছাড়াও দেশের উত্তর থেকে দক্ষিনে যে বিপুল সংখ্যক আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারাও কিন্তু এই ‘পরিবারবাদ’-কেই গ্রহন করেছে এবং তা করেছে জাতীয় স্তরে তাদের দুই বৃহৎ সংস্করণেরই সমানুপাতে, কেবল গুণগত দিক থেকে কংগ্রেস বা সঙ্ঘপরিবারের চেয়ে আরও অনেক বেশী নগ্নভাবে; অনেক বেশী খুল্লমখুল্লা এদের পরিবারতন্ত্র। লক্ষ্যনীয় বিষয় যে, দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলোকে আমরা যত না তাদের পার্টির নামে চিনি, তার চাইতেও বেশী করে চিনি তাদের প্রধান নেতার নামে :  ‘মায়াবতী’-‘মুলায়ম’-‘লালু’-‘নীতিশ’-‘জয়ললিতা’-‘করুনানিধি’-‘মমতা’-‘কেজরী’ এগুলোই পার্টি পরিচিতি হিসেবে কাজ করে আমজনতার মুখে মুখে। বিষয়টা শুনতে স্বাভাবিক এবং বেশ কিছুটা মজাদার লাগলেও ব্যাপারটা আসলে বেশ সুক্ষ্ম এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ন।
প্রথমত, ভারতবর্ষের এই সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো আসলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পার্টি, নামভিত্তিক পরিচিতি যার সবচেয়ে বড় প্রমান। দক্ষিনপন্থী পার্টিতে ব্যক্তির ‘ব্যক্তিস্বত্ত্বা’ যেহেতু নিয়ন্ত্রিত হয় তার পরিবার মারফৎ, পরিবারকে ভিত্তি করেই, তাই এই সমস্ত পার্টি গুলোয় প্রথমে ব্যক্তি ও তারপর তার পরিবারই প্রধান নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক হয়ে ওঠে। ব্যক্তির ‘ব্যক্তি-লিগ্যাসি’ কে এখানে বহন করে পরিবার।
সেজন্যই বঙ্গদেশে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ব্যক্তিনামে পরিচিত তৃণমূলের যোগ্য উত্তরাধিকারী কে, সে প্রশ্নে বিতর্কের মুখে প্রথমে কোনঠাসা ও পরে এমনকি সরে যেতে হয় দলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মুকুলকেও (যদিও বা তাঁর অপসারনের কারণগুলো তার এবং তার প্রাক্তন ও বর্তমান দলের কদর্য রাজনীতির নিরিখে আরও গভীর ও ব্যাপ্ত), যখন পরিবারতান্ত্রিকতার মৌলিক নীতি ‘যোগ্যতম’ হিসেবে বেছে নিতে চায় বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের সন্তান অভিষেককে। সম্ভবত এ নিয়ে কোনও তথ্য, কোনও প্রমানেরই প্রয়োজন পড়ে না যে, পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল দলটি মমতা ছাড়া এমনকি সংজ্ঞাত-ই নয়! এ ছাড়াও মমতার ‘ব্যক্তি-রাজনীতি’-র অন্যত্তম প্রমান হল ’১৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি যে, বিভিন্ন কেন্দ্রে যে-ই প্রার্থী হোন না কেন, ভোট দেওয়ার বেলায় জনগন যেন তাঁকেই প্রার্থী কল্পনা করে তৃণমূলকে বেছে নেন।
পরিবারতান্ত্রিক ‘যোগ্যতা’র সবচাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত রয়েছে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে যথাক্রমে লালু প্রসাদের আর.জে.ডি ও মুলায়মের সমাজবাদী পার্টিতে। গত কুড়ি বছর ধরে আর.জে.ডি’র সুপ্রিমো হিসেবে একইসাথে দলের চেয়ারম্যান ও প্রেসিডেন্টের পদে থেকেছেন লালু। কেবল তা-ই নয়, দলের প্রধান পাঁচজন নেতার মধ্যে চারজনই হলেন লালু, তাঁর স্ত্রী রাবড়ি এবং তাঁর দুই ছেলে তেজস্বী যাদব এবং তেজ প্রতাপ যাদব। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আর.জে.ডি-এর পক্ষ্য থেকে লালু, রাবড়ী (১৯৯৭,’৯৯,২০০০) ও তেজস্বী (উপ-মুখ্যমন্ত্রী, ২০১৫) ছাড়া আর কারুর নাম ওঠেনি কখোনো!
উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টি যাদব পরিবারের নামেই কার্যত চলে। মুলায়ম সিং যাদব, তাঁর পুত্র অখিলেশ, ভাই শিবপাল ও খুড়তুতো ভাই রামগোপাল এই চারজনই এই পার্টির প্রধান চার স্তম্ভ। হালে বিধানসভা নির্বাচনের সময় যখন দলের অন্দরে অখিলেশ-রামগোপাল বনাম মুলায়ম-শিবপালের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে, তখনই যাদব পরিবারের কোন্দলের সুযোগে শক্তিশালী ভিত্তি তৈরী করতে থাকে বিজেপি, যার ফল হিসেবে অবশেষে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে সেখানে সরকার গড়ে বিজেপি। সমাজবাদী পার্টিতে জন্মলগ্ন থেকে এখনো অব্দি প্রেসিডেন্ট ও চেয়ারপার্সনের পদ যাদব পরিবার বহির্ভূত অন্য কারুর হাতে যায়নি।
দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষের পরিবার-কেন্দ্রিক রাজনীতির পথিকৃৎ হিসেবে অবশ্যই উঠে আসে কংগ্রেসের নাম, যাঁদের ভাড়া করা প্রচারকেরা, নেহেরু-গান্ধী পরিবারের জন্যই দেশ স্বাধীন হয়েছে এমন দাবী করতেও পিছপা হন না, চক্ষু-লজ্জার সমস্তটুকু বিসর্জন দিয়ে। এদেশের এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলোর প্রায় সবকটাই কিন্তু তৈরী হয়েছে, হয় কংগ্রেসের সাথে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতার বিভিন্ন ভাগাভাগির প্রশ্নকে কেন্দ্র করে অথবা বিভিন্ন কংগ্রেসী নেতা যাঁদের মতামত কংগ্রেসের প্ল্যাটফর্মে সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি, তাদের ‘আদর্শ’-এর উপর ভিত্তি করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস থেকে ভেঙ্গেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবাংলায় তৈরী হয় তৃণমূল কংগ্রেস  তাদের দাবী অনুযায়ী, তৎকালীন বঙ্গ-কংগ্রেসের, সিপিআই(এম)-এর সামনে চূড়ান্ত নিষ্ক্রিয়তা ও পরাভবের প্রতিক্রিয়ায়। সেটি ছিল এ রাজ্যে কংগ্রেসে ক্ষমতার অধিকারের প্রশ্নে একটি ভাগাভাগি, মূলত এই পরিস্থিতিকে সামনে রেখে যখন এ রাজ্যে বুর্জোয়াদের বিশ্বস্ত ও সক্রিয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করা কংগ্রেসের পক্ষে কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, অথচ নয়া-উদারবাদের আওতায় ব্যপক সাংগঠনিক শক্তি থাকা সত্বেও রাজনৈতিক লাইনের দিক থেকে সিপিআই(এম) ছিল সম্পূর্ণ দোলাচলে। ’৯৬-এ জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রশ্নে সিপিআই(এম)-এর টলমলে অবস্থা স্বাভাবিকভাবেই বুর্জোয়াদের চোখ এড়ায়নি, এবং ’৯৮-তে তৃণমূল কংগ্রেস জন্ম নিল এরাজ্যে বুর্জোয়া শ্রেণীর যোগ্যতম প্রতিনিধি হিসাবে।
বিহারে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল বা নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) তৈরী হয় ১৯৮৮ সালে তৈরী হওয়া ‘জনতা দল’ ভেঙ্গে, যা ছিল জাতীয় কংগ্রেসের কোনঠাসা নেতা জয়প্রকাশ নারায়নের অনুগামীদের হাতে গড়া।
সাম্প্রতিক সময়ে জয়ললিতার মৃত্যুর পর শুধু মুখ্যমন্ত্রীত্বের জন্য যে ঘৃণ্য সংঘর্ষ কোর্ট-কাছারি-জেল-হাজত কিছুই বাকি রাখেনি তাও এক জলন্ত উদাহরণ।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল অরবিন্দ কেজরীবালের আম আদমি পার্টি, যা তৈরী হয় স্বঘোষিত গান্ধীবাদী আন্না হাজারের লোকপাল বিলের দাবীতে দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। সেই গান্ধীবাদেরই প্রভাব রয়েছে কেজরী ও তাঁর ‘আপ’-এর মধ্যেও। গান্ধিজী, যিনি নিজে ছিলেন প্রাচীন ‘বর্ণাশ্রম’ প্রথার একজন অন্যত্তম সমর্থক, পরিবারতান্ত্রিক উত্তরাধিকারের মৌলিক দর্শনটা তাঁর হাত ধরেই প্রাথমিকভাবে কংগ্রেসে ঢুকেছিল। গান্ধীটুপিধারী কেজরীবালের গান্ধীবাদী ‘আপ’ সেই পরিবারতন্ত্রকে ছেড়ে বেশীদিন টিঁকে থাকতে পারে কিনা সেটা অবশ্যই দেখবার বিষয়।
এই পরিবারতন্ত্র এইসমস্ত আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষেত্রে একদিকে যেমন তাদের সংগঠনের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রকে পিষে মারে পারিবারিক জায়গীরদারী মারফৎ, অন্যদিকে বিভিন্ন আঞ্চলিক দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতিতে হয়ে ওঠে মুখ্য সহায়ক ভিত্তি। একদিকে পরিবারবাদ যেমন পরিবার-সদস্যদের উপর ছেড়ে দেয় লাগামহীন রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্তৃত্ব, অন্যদিকে তেমনই সংগঠনের অভ্যন্তরে নির্বিবাদে একনায়কতন্ত্র ও পরিবারতন্ত্রকে জিইয়ে রাখতে গিয়েই ‘পরিবার-বহির্ভূত’ ‘শক্তিমান’রা পেয়ে যান ‘উপ-আঞ্চলিক প্রভূত্বের জায়গীর’ খানিকটা নির্বিবাদের উপঢৌকন স্বরূপ যা সর্বতোভাবে তৈরী করে আঞ্চলিক দুর্বৃত্তায়ন, দুর্নীতি ও লুম্পেনরাজ।
আঞ্চলিক পার্টিগুলোর পরিবারতন্ত্রের সাথে কংগ্রেসী পরিবারতন্ত্রের ফারাক এখানেই যে, প্রথমটির ক্ষেত্রে যেখানে ‘অগণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’-ই সর্বজনস্বীকৃত হয়, সেখানে ‘মেকি গণতান্ত্রিক সংগঠন’-এর মুখোশ পরে বেঁচে থাকতে হয় দ্বিতীয়টিকে; যার প্রমান মেলে যখন বিগত ছেষট্টি বছরের মধ্যে ৩৭ বছরই দলের সভাপতি পদে নেহেরু-গান্ধী পরিবারেরই সদস্য থাকা এবং বাকী ২৯ বছর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার-বহির্ভূত কিন্তু পরিবারেরই একান্ত পোষ্য দাসেদের ঐ পদে আসীন হওয়ার ঘটনায়! আসলে ‘ন্যাশানাল মার্কেটে’ কংগ্রেসের ‘পারিবারিক দাদাগিরি’-র প্রতিক্রিয়ায় তার-ই ঔরসে তৈরী হওয়া আঞ্চলিক দলগুলি ঐ একই পরিবারতন্ত্রের আমদানি করে ‘রিজিওনাল মার্কেট’-এ, যাবতীয় কংগ্রেসী বৈশিষ্ট্য সমেত, যা কার্যত একটি আঞ্চলিক পারিবারিক রাজনৈতিক প্রভূত্ব ব্যতীত আর কিছুই নয়।

।। ২ ।।

দুর্নীতির সাথে বুর্জোয়া পার্টিগুলোর সম্পর্ক সুবিদিত। এর জন্য বিশেষ তাত্ত্বিক চর্চা লাগে না, জটিল আলোচনারও প্রয়োজন পড়ে না – স্বাধীনতার পর থেকে গত সাত দশকে দেশের ইতিহাসের যাবতীয় দুর্নীতি বা স্ক্যামগুলোর একটা লিষ্ট বানালেই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। স্বাধীনোত্তর ভারতে কি কংগ্রেস কীই বা বিজেপি, উভয়েই ব্যপক পরিমানে দুর্নীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। সকলেই জানেন যে ২০১৪-এ গোটা দেশ জুড়ে কংগ্রেসের পরাজয়ের প্রধান কারণই ছিল তাঁর লাগামছাড়া দুর্নীতি। বিপরীতে বিজেপির কথা বলাই বাহুল্য। কয়লা, জমি, গুজরাত স্টেট পেট্রোলিয়াম এবং গুজরাত উরজা বিকাশ নিগম মিলিয়ে কেবল আদানি গ্রুপের সাথে মিলে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকারে কেলেঙ্কারির আর্থিক পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই আমরা দেখিয়েছি যে, দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলি কীভাবে কংগ্রেসী পরিবারতন্ত্রিক লিগ্যাসি বহন করে যা আঞ্চলিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নকে প্রভাবিত করে। এবার আমাদের লক্ষ্য করতে হবে যে, এইসমস্ত আঞ্চলিক দলগুলি বিভিন্ন দুর্নীতিতে কিভাবে ভূমিকা নেয়। পূর্বে উল্লিখিত আঞ্চলিক দলগুলোর কথাই যদি ধরে নিই, তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, এই মুহুর্তে বিজেপি ও কংগ্রেসের মত বৃহৎ বুর্জোয়া পার্টিগুলোর তুলনায় দুর্নীতিতে কোনও অংশেই তারা কম যায় না। দক্ষিণে জয়ললিতা, উত্তরে মায়াবতী এবং পূর্বে মমতা-র পার্টি এ ব্যাপারে কার্যত মাইলষ্টোনের ভূমিকা পালন করছে।
উত্তরপ্রদেশে ২০০২-২০১০ এর মধ্যে ‘ফুডগ্রেন দুর্নীতি’, ২০১২ তে ‘এনআরএইচএম দুর্নীতি’ (এতে রাজ্য সরকারের ক্ষতির পরিমান ছিল ১০হাজার কোটি টাকা), ‘তাজ হেরিটেজ করিডোর কেস’ (১৭৫ কোটি টাকার দুর্নীতি), ‘স্টাচু কেস’ (৪০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি) বিপুল মাত্রার সব দুর্নীতিগুলির মধ্যে অন্যত্তম! ১৯৯৫ সালে মায়াবতীর মোট সম্পত্তির পরিমান যেখানে ছিল ১.১২ কোটি টাকা, ২০১২ সালে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি, যার মধ্যে শেষ দু’বছরে (২০১০-১২) সম্পত্তির পরিমান বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা!
১০০ কোটি টাকার ফোডার দুর্নীতিতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে নয়ের দশকে দীর্ঘদিন জেল খেটেছিলেন তৎকালীন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। তাঁর পুত্র তেজস্বী-ও সম্পত্তি সংক্রান্ত দুর্নীতির দায়ে সিবিআই ও ইডি-র জেরার কবলে পড়েছেন দীর্ঘদিন।
দুর্নীতিতে দেশের প্রথম সারির অভিজ্ঞদের একজন তামিলনাড়ুর সদ্য-প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের জন্য গ্রেফতার হন ‘কালার টিভি দুর্নীতি’-কে কেন্দ্র ক’রে। অভিযোগ ছিল, গোটা রাজ্য জুড়ে পঞ্চায়েত-এর কমিউনিটি সেন্টারে ১২০০০ টাকা বাজার-দরের ৪৫,৩০২ টি কালার টেলিভিশন কেনা হয় ১৪,৫০০ টাকায়, যার দরুন প্রায় ১১ কোটি টাকার লোকশান করে রাজ্য-সরকারের ! ১৯৯৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে এ.আই.ডি.এম.কে হেরে যাওয়ার পর, নবগঠিত ডি.এম.কে সরকারের পক্ষ্য থেকে জয়ললিতার বিরুদ্ধে তাঁর বিপুল পরিমানের সঞ্চিত সম্পত্তিকে কেন্দ্র ক’রে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। ’৯৬-এর তদন্তে উঠে আসে ২৮ কেজি সোনা, ৮০০ কেজি রূপা, ১০৫০০ টি শাড়ী সহ তামিলনাড়ু, হায়দ্রাবাদ ও কর্ণাটকে বিলাসবহুল বাংলো-ফার্মহাউস থেকে শুরু করে কৃষিজমি এমনকি নীলগিরিতে একটি চা বাগান মিলিয়ে ৩০০০ একর জমি-সহ বিভিন্ন নামী-বেনামী অ্যাকাউন্ট মিলিয়ে মোট ৬৬.৬৫ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে দ্রাবিঢ় দেশের আম্মার, যা ২০১৬-র অর্থনীতিতে ২৫৫ কোটি টাকা বা ৪০ মিলিওন মার্কিন ডলারের সমতুল্য! প্রায় ১৮ বছর ধরে চলা মামলার ভিত্তিতে ২০১৪ সালে তামিলনাড়ুর তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা, তাঁর ছায়াসঙ্গী শশীকলা সহ মোট চারজনের চার বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি জয়ললিতার ১০০ কোটি টাকা এবং বাকীদের ১০ কোটি টাকা ক’রে জরিমানা জারি করে সুপ্রিম কোর্ট পরিচালিত বিশেষ আদালত।


দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় হেরে যেতে রাজী নন আম্মার চিরশত্রু তামিলনাড়ুর ডি.এম.কে নেতা এম.কে. করুণানিধিও। এমনিতে তাঁর পুত্র স্তালিনের রাজনৈতিক উত্থানকে ঘিরে স্বজনপোষনের অভিযোগ তো আছেই, পাশাপাশি বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ভীরানম লেক প্রোযেক্টের ‘টেণ্ডার অ্যালটমেন্ট’-কে কেন্দ্র ক’রে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে সরকারিয়া কমিশন। ২০০১ সালে তিনি গ্রেফতার হন ফ্লাইওভার নির্মান দুর্নীতির কারনে। এমনকি রাজীব গান্ধী হত্যা মামলাতে এল.টি.টি.ই-কে সহযোগিতা করার মত অভিযোগ-ও তোলা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে, জৈন কমিশনের পক্ষ্য থেকে! টু-জি কেলেঙ্কারিতে তাঁর কন্যা ও বর্তমান রাজ্যসভা সাংসদ কানিমোজি এবং তাঁর স্ত্রী দয়ালু, প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ.রাজার সহযোগিতায় ‘কলাইগ্নর টিভি’-তে ঘুরপথে প্রায় ৩৬.২ মিলিওন মার্কিন ডলার চালান করেন, যে চ্যানেলে দয়ালু ও কানিমোজির স্টেকের পরিমান যথাক্রমে ৬০% ও ২০%! ২০১২ সালে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটিকে ই.ডি জানায় যে, তাদের কাছে কানিমোজি ও দয়ালু দোষী সাব্যস্ত করার মত যথেষ্ট প্রমান রয়েছে।
অখিলেশের মুখ্যমন্ত্রীত্বে সমাজবাদী পার্টির ক্ষমতায় থাকার সময় উত্তরপ্রদেশে গোমতী রিভার প্রোযেক্টে ৫০ কোটি টাকারও বেশী দুর্নীতি হয়েছে। ১২০০ কোটি টাকার রাজ্য সরকারের মালিকানাধীন একটি ‘সাত তারা’ গ্রেডের বাড়ি অখিলেশ ১৫ বছরের জন্য লিজ দেন তাঁর পরিচিত এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে মাত্র ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা বার্ষিক ভাড়ায়। ‘জয়প্রকাশ নারায়ন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ তৈরীকে কেন্দ্র ক’রে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতা পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অখিলেশ-পরিচিত ব্যবসায়ীদের হাতে টেণ্ডার দেওয়া ছাড়াও, বিভিন্ন দিকে কোটি কোটি টাকার নয়ছয় হয়েছে। ২০১২ সালেই উঠে আসে ফুডগ্রেন দুর্নীতির (৩৫,০০০ কোটি টাকা) কথা যাতে সমাজবাদী পার্টির অন্যত্তম সদস্য বিনোদ সিং-এর দুই ভাই নরেন্দ্র সিং আর মহেশ সিং জড়িত ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে, মায়াবতীর মত দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তিমূলক রাজনীতিই মুলায়ম-অখিলেশের নেতৃত্বে সমাজবাদী পার্টি করে থাকে, যাদের প্রতিক্রিয়াতেই সেখানে শক্তিশালী হতে থাকে বিজেপি-র সংগঠন যা অবশেষে ’১৬-র বিধানসভা নির্বাচনে যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বে বিজেপি-র বর্বর রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠায় আনে।
ওড়িষায় বিজু জনতা দলের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগই হল চিটফান্ড দুর্নীতিকে কেন্দ্র ক’রে দলের তহবিলে বিপুল পরিমানে অর্থ সঞ্চিত করা। ২০১৪ বিধানসভা নির্বাচনে সুভাষ মহাপাত্র নামে জনৈক আর.টি.আই অ্যাক্টিভিস্ট বি.জে.ডি’র তহবিল সংক্রান্ত অর্থনৈতিক হিসেব নিকেশের ব্যাখা চেয়ে মামলা করেন, যার ভিত্তিতে এবছর ওড়িশা হাইকোর্ট ইলেকশন কমিশনের কাছে একটি নোটিশ জারী করেছে, দাখিল হওয়া আর.টি.আই মামলাটির ভিত্তিতে যথোপযুক্ত তদন্ত করার জন্য। ২০০৯-র বিধানসভা নির্বাচনে, খনি মাফিয়াদের থেকে বিপুল পরিমানে অর্থ আসে বিজেডির পার্টি তহবিলে। ২০১০ সালে যখন রাজ্যের খনি কেলেঙ্কারি সামনে আসে, এম.বি সাহ কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকা ক্ষতি হয় রাজ্য সরকারের, যা দেশের বৃহত্তম খনি দুর্নীতি এবং যাতে নবীন পট্টনায়ক ও তাঁর দল এবং মন্ত্রীসভার সদস্যদের ব্যপক ভাবে জড়িত থাকার ইঙ্গিত ওঠে।


বিহারে নীতিশ কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ১১,৪১২ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে মূলত ২০০২-০৮-এর মধ্যে এমএনরেগা এবং জলসম্পদ, মানবসম্পদ, স্বাস্থ্য ,খনন, পূর্ত ও অর্থ বিভাগের বিভিন্ন অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতাকে ঘিরে। সম্প্রতি উঠে এসেছে সৃজন মহিলা বিকাশ প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি ভাগলপুরের এনজিও-তে গত দশ বছরের বেশী সময় ধরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকারও বেশী সরকারী টাকা বিভিন্নভাবে চালান করা হয়েছে! ফলস্বরূপ সিবিআই-এর নজরে পড়ে যান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ এবং উপমুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী সুশীল মোদী সহ তাঁর মন্ত্রীসভার অনেকেই। আচমকা বিজেপি-বিরোধী ‘মহাগঠবন্ধন’ ভেঙ্গে, নীতিশের এন.ডি.এ-কে সমর্থন করার মধ্যে যে ‘সিবিআই-জুজু’-র ভয়ে পিঠ বাঁচানোর মহা সত্য-ই লুকিয়ে আছে তা নিঃসন্দেহেই বলা যায়!
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের নেতৃত্বে দুর্নীতির পারদ মাত্র ছয় বছরেই ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়ে দিয়েছে। চিটফাণ্ড দুর্নীতিতে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের টাকা গায়েবে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রীসভার সদস্য, তৃণমূলের সাংসদ-বিধায়ক এবং দলের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ নেতারা। হিসেব বলছে যে সারদা চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারীতে মোট দুর্নীতি ছিল টাকার অঙ্কে ৪০০-৬০০ কোটি, যার গোটাটাই এসেছিল প্রধানত রাজ্যের একান্ত গরীব অংশের মানুষের পকেট থেকে। এই কেলেঙ্কারীর অন্যত্তম কারীগর রাজ্যের প্রাক্তন পরিবহন-মন্ত্রী মদন মিত্র দুর্নীতির দায়ে জেলও খাটলেন দীর্ঘদিন! সিবিআই-এর জুজু তাড়া করে বেড়াচ্ছে তৃণমূলের নেতা সুদীপ থেকে শোভন সবার পিছনেই। তাড়া খেয়ে মুকুল তৃণমূল থেকে “ভ্যানিস্‌” হয়ে “সোনার কেল্লা” খুঁজে পেতে বিজেপিতে। রোজভ্যালি চিটফাণ্ড কাণ্ডে তৃণমূলের কুখ্যাত অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল-ও হাজতে ছিলেন অনেকদিন। এটা মোটামুটি ৪০,০০০ কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতি যা এখোনো পর্যন্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে বৃহত্তম চিটফাণ্ড স্ক্যাম। অতি সম্প্রতি মমতার ভাইপো তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জড়িয়ে পড়েছেন ‘বিশ্ব বাংলা’-কাণ্ডে।
এ প্রসঙ্গে প্রথমেই যেটা তুলে ধরা প্রয়োজন, তা হল নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতে ঘোষিত ভাবে নয়া-উদারবাদের প্রবেশ অর্থনীতির চরিত্রে যে মূলগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিল যার প্রভাব সামাজিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই পড়েছিল, তা দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তোলে লাগামছাড়া ভাবে। নয়া-উদারবাদের সাথে দুর্নীতির এই সম্পর্ককে বোঝার জন্য আমরা প্রথমে দেখে নেব দেশের প্রধান প্রধান দুর্নীতিগুলো সংখ্যার দিক থেকে কি পরিমান বেড়েছে, কার্যত প্রায় এক্সপোনেনসিয়ালি, এই নয়া-উদারবাদের যুগে।

এই দুর্নীতির বিকাশ ঘটে নয়াউদারবাদের যুগে প্রথমত, বড়ো বড়ো একচেটিয়াগুলোর স্বার্থে ও দ্বিতীয়ত, বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-মন্ত্রী ও তাদের অমাত্যদের পকেট ভরতে, জনগনের সম্পত্তি ও অর্থের ব্যপক লুঠের মাধ্যমে।
নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়নের যুগে ‘স্টক ট্রেডিং’ যা ছিল অবিক্রীত পণ্যের দামের ওঠানামাকে কেন্দ্র ক’রে শেয়ার মার্কেটে ফাটকাবাজি, কেন্দ্রীয় ভাবে তাকে প্রতিস্থাপিত করেছে, এখোনো অব্দি উৎপন্ন হয়নি এমন পন্যের উৎপাদনের বিভিন্ন কন্ট্র্যাক্টের উপর ভবিষ্যৎ নির্ভর ফাটকাবাজি মারফৎ মুনাফা তুলে আনার প্রবণতা। ফলে অ্যাসেট-এর দামের ফানুস ফুলে ফেঁপে ওঠা মাত্রই, চুপসে যাওয়ার আগেই, চটজলদি তার ভাগ পেতে মরিয়া কর্পোরেটগুলো রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের ঘুষ দিয়ে সব রকমের অ্যাসেট, বিশেষত বৃহৎ উৎপাদন ক্ষেত্রের প্রাকৃতিক উৎসগুলোর বরাত, দখলে নিতে উদ্যত হয়। আজকের অধিকাংশ দুর্নীতিই একে কেন্দ্র করেই। আর চিটফান্ডগুলি নিজেরাই জনগণের থেকে টাকা তুলে শেয়ার মার্কেটে ফাটকা খেলায় লাগানোরই সংস্থা, ফলে সে দুর্নীতি যে প্রত্যক্ষ ভাবেই নয়া-উদারবাদের ফসল, তা বলাই বাহুল্য।
একদিকে বিপুল প্রাচুর্য আর অন্যদিকে বিপুল অভাবের এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়েই বেড়ে ওঠে দূর্নীতি ও সমাজবিরোধী-নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি। নয়া-উদারবাদের হাতে গড়া বিপুল সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্য তাদেরকে ঠেলে দেয় নয়া-উদারবাদেরই স্বার্থে দুর্বৃত্তায়নে ভূমিকা পালন করতে, যাতে নেতৃত্ব দেয় বৃহৎ বুর্জোয়া পার্টিগুলো সহ বিশেষ করে এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলি। বিপুল সংখ্যক বেকার যুবকেরা এভাবেই ব’নে যায়, ‘দুর্বৃত্ত-কবলিত’ আঞ্চলিক দলগুলোর ঠ্যাঙ্গাড়ে-বাহিনী। উদাহরণস্বরূপ, রিয়েল এস্টেটের ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে শেয়ারের বাজারে যে বিপুল ভবিষ্যৎ নির্ভর ফাটকা খেলা হয়, তার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠছে জমি মাফিয়া থেকে প্রোমোটার-রাজ থেকে সিণ্ডিকেট!
তথ্য বলছে, ৩০% লোকসভা সাংসদ ও ৩১% বিধায়ক গুরুতর ক্রিমিনাল চার্জে জর্জরিত। এর মধ্যে দল হিসেবে সাংসদ-বিধায়ক নির্বিশেষে কংগ্রেসের ২১%, বিজেপি’র ৩১%, সমাজবাদী পার্টির ৪৮%, আর জে ডি’র ৬৪% এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার ৮২% জনপ্রতিনিধি গুরুতর অপরাধমূলক মামলায় অভিযুক্ত। এ রাজ্যে তৃণমূলের বিধায়কদের মধ্যে ১০৭ জনের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেসের অভিযোগ রয়েছে যার মধ্যে ৯৩ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধের মামলা চলছে।
নয়া-উদারবাদের এই জমানায় পুরোনো যুগের ‘রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত দুর্বৃত্তায়ন’ পরিবর্তিত হয়েছে ‘দুর্বৃত্ত নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি’-তে যার মধ্যে দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে গজিয়ে উঠছে ‘পাওয়ার পলিটিক্স’ যাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে এইসমস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির বিকাশের অনুকুলে এই রাজনৈতিক দলগুলো দেশের তামাম মালিক শ্রেণীর আঞ্চলিক এজেন্ট হিসেবেই কাজ করছে যেমনটা তাদের বৃহৎ সংস্করণ হিসেবে কংগ্রেস ও বিজেপি ক’রে থাকে।

।। ৩ ।।

বিজেপি-বিরোধী সংগ্রামের প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতা যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হবে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ-ই নেই। বিশেষত বিজেপি বিরোধী মহাজোটের প্রধান লাইন-ই হ’ল ‘গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ’! এমনিতে দেশের সংবিধানের বাধ্যবাধকতায় ধর্মীয় বর্বর বিজেপি-ও তার ‘পার্টি কর্মসূচী’-তে ‘ধর্ম-নিরপেক্ষতা’র বাণী আউড়ায় যা তামাম দেশবাসীর কাছে কৌতুকের সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই হতে পারেনা। কিন্তু কংগ্রেস সহ অন্যান্য দক্ষিনপন্থী পার্টিগুলো যারা ‘ধর্ম’-কে ‘নিরপেক্ষতা’-র সাথে জোড়ে সব ধর্ম থেকেই কয়েকজন সাংসদ-বিধায়ক রেখে, আর মন্দির এবং মসজিদ উভয় গড়তেই জনগনের টাকা থেকে কিছু অনুদান দিয়ে, ‘ধর্ম’ এবং তার ‘নিরপেক্ষতা’ রক্ষা যে তাদের কাছে একটি রাজনৈতিক ‘ভোট বর্ধক যন্ত্র’ বৈ আর কিছুই নয়, তার প্রমান মেলে পশ্চিমবাংলা থেকে বিহার, উত্তরপ্রদেশ থেকে কর্ণাটক সর্বত্র বিজেপি’র সাথে হাতে হাত মিলিয়ে ঠিক কীভাবে রাজনৈতিক দাঙ্গাগুলোয় মদত দেয় কংগ্রেস-সহ এই আঞ্চলিক দলগুলো তার ঘটনায়।
স্বরাষ্ট্র দফতরের পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কর্ণাটকে মোট ৩৩৬ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৯৩৯ জন মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন এবং ১৬ জনের মৃত্যু ঘটেছে, যার মধ্যে কেবল ’১৫ সালের জানুয়ারী থেকে জুনের মধ্যেই এমন ৩৬টি ঘটনা ঘটেছে, যার জেরে ১২৩ জন আহত হয়েছেন ও ২ জন মারা গেছেন। ২০০৮ থেকে ১৩ সাল পর্যন্ত সরকারে বিজেপি থাকলেও, ’১৩ সালের পর থেকে সেখানে সরকার চালাচ্ছে কংগ্রেস এবং এই ধরণের দাঙ্গা মারফৎ রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে তারা – ঠিক বিজেপির-ই প্রতিবিম্বের মত!
২০১৩ সালের আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ উত্তরপ্রদেশের মুজফফরপুরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক মাত্রায় মাথাচাড়া দেয় যার ফল হিসেবে ৪২ জন মুসলিম ও ২০ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ৯৩ জন আহত হন। এই ঘটনায় একদিকে যেমন অখিলেশ যাদবের সরকার নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে এই দাঙ্গাকে কেবল বাড়িয়েই তোলেনি এমনকি সমাজবাদী পার্টি নিজেই এই দাঙ্গায় গুরুত্ব-পূর্ণ ভূমিকা নেয় বিজেপির প্রতিবিম্ব রূপে। দুই দলের পোষ্য লুম্পেন বাহিনীর নেতৃত্বে চলে খুনের লীলা যা পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী মানুষকে ঘরছাড়া করে। সুপ্রিম কোর্টের রায়েও অখিলেশ এন্ড কোং সরকারী অকর্মন্যতার দোষে দুষ্ট।
পশ্চিমবাংলায় বিগত ৩-৪ বছরে তৃনমূলের সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক ভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে। ধূলাগড়, চন্দননগর, বসিরহাট সর্বত্রই বিপুল সাম্প্রদায়িক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। গত ১১ মাসে রাজ্যে এমন ১১ টি সাম্প্রদায়িক হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। সর্বত্রই তৃণমূলের গুণ্ডাবাহিনী বিজেপি ও আর এস এস-এর লুম্পেনদের সাথে পরিকল্পনামাফিক এই ধরণের দাঙ্গা বাঁধিয়েছে একটি ‘সাম্প্রদায়িক টেনশন’কে সৃষ্টি করার জন্য।
বিহারে লালু বা নীতিশের আর.জে.ডি বা জে.ডি(ইউ) উভয়েই এই সাম্প্রদায়িক খেলার দীর্ঘদিনের খেলোয়াড়! সেখানে দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক নিপীড়নের উপর ভিত্তি করে পরিচিতি স্বত্ত্বা-ভিত্তিক রাজনীতির প্রচার করে এই দুই দল। একই কথা প্রযোজ্য উত্তরপ্রদেশে মায়াবতীর বিএসপি-র ক্ষেত্রে। ‘দলিত রাজনীতি’-র নামে ‘দলিত’ এই পরিচিতি-স্বত্ত্বার এক ব্যপক ‘পলিটিকাল মার্কেটিং’-এর মাধ্যমে ভোট বাড়ানো-ই যে মায়াবতীরলক্ষ্য তা নিয়ে সন্দেহ নেই বিন্দুমাত্র।
এটা ভুললে চলবে না যে, বিজেপি-র উগ্র-হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যেভাবে সংখ্যাগুরু রাজনীতির বাজারকে উত্তপ্ত করতে চায়, তার প্রতিক্রিয়ায় তৈরী হয় উদারপন্থী বুর্জোয়া পার্টিদের মেকি-ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতি। আর ঠিক সেজন্যই তিন-তালাক বিতর্কে বিজেপি যখন মুসলমান-বিরোধী আগ্রাসনে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, একটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরনের লক্ষ্যেই তৃণমূল-ও প্রকাশ্য সভায় গোঁড়া ভাবে সমর্থন করে বসে তিন-তালাককে এবং উভয় দলেরই কোনও বক্তব্যে মুসলমান মহিলাদের মতামত ও ক্ষমতায়ণের প্রশ্নের ছিঁটেফোঁটা-ও পাওয়া যায় না।


ভুললে চলবে না যে, দেশের বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা যা চল্লিশের দশকে দেশভাগের সময় ছড়ায় তাতে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল ব্যপক মাত্রায়। আঞ্চলিক দলগুলোও বেড়ে ওঠে ঐ কংগ্রেসী দর্শনকেই সামনে রেখে যা ধর্মনিরপেক্ষতাকে উপস্থাপিত করে, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ’ হিসেবে নয়, বরং সমস্ত ধর্মের সাথে ‘সমপরিমান নৈকট্য’ বজায় রাখা হিসেবে, যার লক্ষ্যই হল বিভিন্ন নির্বাচনী বা সঙ্কটজনিত পরিস্থিতিতে তাদের দুষ্কৃতি বাহিনী মারফৎ ব্যাপক মাত্রার ‘সাম্প্রদায়িক টেনশন’ তৈরী করা। তাই সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, কংগ্রেস বাদই দিলাম, আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলোর সাথেও মিলিত হয়ে বিজেপি-র বিরোধিতা করতে যাওয়া আসলে পাড়ার ছিঁচকে চোরেদের সাথে নিয়ে রঘু ডাকাত ধরতে যাওয়ার সামিল, যেখানে চোরেদের সম্পত্তির ভাগীদার করলেই দল পালটে যেকোনো মুহূর্তে চোরেরাও ডাকাতের দলে ভিড়ে যাবে! সাম্প্রতিক সময়ে নীতিশের ভোল বদল বা এরাজ্যে মুকুলের ‘বিজেপি-গমন’-ই কি তার যথেষ্ট প্রমান নয়? তাছাড়া, এই আঞ্চলিক দলগুলো প্রায় সবকটাই কোনও না কোনও সময় বিজেপি-র সাথে জোট করে ক্ষমতার প্রসাদের ভাগ পেতে। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন এরাজ্যের মমতা, একমাত্র যিনি নিজে বিজেপি ও কংগ্রেস উভয়ের জোট সরকারেরই ক্যাবিনেট মিনিস্টার ছিলেন। সেসময় ‘বিজেপি’-র ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য প্রস্ফুটিত হচ্ছিল এমন দাবী কেউ করবেন কী!

গোটা আলোচনা থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, ‘বিজেপি-বিরোধী মহাজোট’-এর লক্ষ্যে কংগ্রেস সহ যে-সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলিকে ‘বিজেপি-বিরোধী সংগ্রাম’ (পড়ুন ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন)-এর সৈনিক হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে প্রচারমাধ্যমে, তাদের রাজনীতির প্রধান চারটে স্তম্ভ-ই হল পরিবারতন্ত্র, দুর্নীতি, দূর্বৃত্তায়ন এবং সাম্প্রদায়িকতা! এমনকি ‘বুর্জোয়া প্যারামিটার’-এও ‘গণতন্ত্র’ বলতে আম-আদমি যা বোঝে, তার সাথে অন্তত ‘অফিসিয়ালি’ এই চারটির একটিও খাপ খায় ব’লে তো মনে হয় না! বিপরীতে এঁদের বোঝা ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতেই জনগণ উপায়ান্তর না দেখে বিজেপি-র মতো ঘৃণ্য পাশবিক এক দলের কাছে মাথা নত করছেন।
আসলে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে ভারতবর্ষে নয়া-উদারবাদের বিকাশ, অর্থনীতির অনুকুলেই রাজনীতিকেও পাল্টেছে ব্যপক মাত্রায়। নয়া-উদারবাদের আওতায় ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের মাত্রা একদিকে যখন চরমে উঠেছে, তখন তার-ই প্রতিক্রিয়ায় তৈরী হয়েছে বিপুল এবং ব্যপক দূর্নীতি ও দূর্বৃত্তায়ন। লক্ষ্যনীয় বিষয় এটাও যে, আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে কয়েকটিকে বাদ দিলে বাকী সবেরই জন্ম ১৯৯০-এর পরে!
এই সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলো যে আসলে কংগ্রেস ও বিজেপি’র-ই ক্ষুদ্র সংস্করণ তা নিয়ে তাই সন্দেহ নেই কোনো। এমনকি এই সবকটি দলের মধ্যেই স্বচ্ছ দৃষ্টিতেই একটি করে কংগ্রেস দৃশ্যমান। বিজেপি-র সাথে কেবল এটুকুই ফারাক যে, প্রথমত, বিজেপি একটি আপদমস্তক ফ্যাসিস্ত প্রবণতায় ভরা উগ্র হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী সংগঠন আর.এস.এস কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত, যারা ঘোষিত ভাবে ভারতের সমস্ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে চুরমার করে দেশকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানাতে চায়, এবং দ্বিতীয়ত, বিজেপির প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িকতার তীব্রতা এতটাই যে, তা কার্যত সব ধরণের বিতর্কের উর্ধ্বে – এটি একটি ঘোষিত প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক শক্তি।
বাদবাকী সমস্ত ক্ষেত্রে, অর্থনৈতিক সমস্ত কর্মসূচীর প্রশ্নে তাদের সাথে কংগ্রেস সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির কোনও তফাৎ-ই নেই, যার জ্বলন্ত উদাহরন হল কংগ্রেস সহ সমস্ত আঞ্চলিক দলের নোটবন্দী ও জিএসটি-কে স্বাগত জানিয়ে কেবল তার পদ্ধতি-প্রকরণ নিয়ে আপত্তি করা। এদের সকলের কাছেই সাম্প্রদায়িকতা প্রতিহতকরণ আসলে বিজেপি কর্তৃক পরিচালিত ‘হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতা’-র বিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িক পোলারাইজেশন তৈরি – বিজেপি-আরএসএস-এর বানানো ধর্মের ট্র্যাপে জনগনকে ঠেলে দেওয়া এবং ধর্মের নামেই জনগণের ঐক্য ভেঙ্গে অবিজেপি ভোট কুড়ানো যার লক্ষ্য। আর ঠিক সেজন্যই পশ্চিমবাংলায় বিজেপি-র হিন্দু সন্ত্রাসের পালটা চাল দেন মমতা ‘ইমাম ভাতা’ দেওয়ার প্রস্তাব ক’রে, যদিওবা ‘তেলেভাজা’ শিল্পের বাংলায় মুসলমান যুবকদের চাকরির হার কত, বা গ্রাম বাংলার মুসলমান চাষি ফসলের কত দাম পেলেন সেটা বেমালুম চেপেই যান তিনি।
ভারতবর্ষের সমস্ত কটি রাজ্যে যেখানে যেখানে বিজেপি’-র ক্ষমতায়ণ ঘটেছে বা তাদের সংগঠন ক্রমবর্ধিষ্ণু হয়েছে, তার অন্যতম কারনই হল কংগ্রেস সহ অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলির ব্যপক দুর্নীতি ও জন-বিরোধী কার্যকলাপ এবং প্রকৃত বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির অভাব, যুগপৎ ভাবে। অসম, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড সর্বত্রই বিজেপি-র উত্থানের একটি অন্যত্তম কারণ হল এটি। পশ্চিমবাংলায় এই পরিস্থিতিটিকে বোঝা যায় খুব সহজেই। এখানে তৃণমূলের দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়নকে ঘিরে তৈরী হওয়া লুম্পেনরাজ ও বামেদের রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা প্রত্যেকদিন বিজেপি-র সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করছে। মানুষ তৃণমূলের উপর রুষ্ট এবং বিজেপি-র সাম্প্রদায়িক হিংসার রাজনীতিকেও সমর্থন করেন না; তবুও এই দুয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে তাকে অবশেষে দুয়ের মধ্যে একটিকেই বেছে নিতে হচ্ছে, যা আখেরে দক্ষিনপন্থাকেই শক্তিশালী করে তুলছে। এই সহজ সত্যকে সমস্ত সাধারন মানুষ যতটা সহজে বোঝেন দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটা অনুধাবন করার ক্ষমতা আজ প্রতিষ্ঠিত ‘কমিউনিষ্ট’ নামাঙ্কিত পার্টিগুলির নেতৃত্ব হারিয়েই ফেলছেন, যার ফল হিসেবে বামপন্থী মহল থেকেই উঠে আসছে এই ধরণের ‘মহাজোট’-এর লাইন। মাত্র কয়েকদিন আগেই এরাজ্যের জনসভায় বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেস তো বটেই এমনকি তৃণমূল সহ সমস্ত আঞ্চলিক দলগুলোকে নেওয়ার কথা জোরের সাথে প্রচার করেন সিপিআই-এর ‘হাই-টিআরপি’ ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার। একই কথার সুর বাজতে দেখা যায় সিপিআই(এম)-এর হেভিওয়েট নেতা গৌতম দেবের কণ্ঠেও!
সমস্যার জায়গাটা এটাই যে, যখন বিগত বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে রুখতে কংগ্রেসের সাথে জোট করার মধ্যে দিয়ে এ রাজ্যে কমিউনিষ্টরা আদর্শগত পক্ষাঘাতের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ভোটের বিচারে এবং সংগঠনের বিচারেও ব্যপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তখন আরও একবার শ্রেণী-প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে নয়া-উদারবাদ ও ফিনান্স পুঁজির এক লাডলাকে সরাতে অন্য চোখের মণিদের সাথে হাত মেলানো এক চরম আত্মঘাতী পরিকল্পনা ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে, এই সমস্ত জোটকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলো ‘কমিউনিষ্ট’ নামধারী নেতারা বাস্তবায়িত করছেন “জনগনের ইচ্ছে”-র অজুহাতে, “মাস্‌ লাইন”-এর নামে, যা বাস্তবে সাধারণ গরীব মেহনতী জনতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে সবচেয়ে বেশী। ভুলে যাওয়া চলে না, শ্রমিক ধর্মঘটের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকারকে পিষে মারছে যে দল, ধর্মঘটের দিন কাজে না এলে পাওনা ছুটি হাতে থাকা সত্ত্বেও মাইনে কেটে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, অভূতপূর্ব ভাবে পুলিশকে দিয়ে মাইক-প্রচার চালাচ্ছে ধর্মঘট করা যাবে না বলে, তাদের সাথে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে জোট করাটা ‘শ্রমিক শ্রেণির অগ্রগামী বাহিনী’ বলে নিজেদের যারা দাবী করে তাদের নিজেরই বক্তব্যের সাথে বেইমানী করা নয় কি?
নয়াউদারবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার জোড়া বিষের বিপদ নিয়ে একদিকে যখন মেহনতী জনসাধারণের দিকে তেড়ে আসছে বিজেপি, তখন তার-ই যমজ ভাইদের সাথে ‘মহাজোট’ হল বুর্জোয়াদের পাতা একটা ফাঁদ; যে ফাঁদে পা না দিয়ে মেহনতী জনগনকে সংগঠিত হতে হবে, লুঠে খাওয়াদের বিরুদ্ধে খেটে খাওয়াদের সংগ্রামের পতাকা কাঁধে – তৈরি করতে হবে প্রকৃত বিকল্প, নিজেদের সংগ্রামের প্রকৃত হাতিয়ার হতে পারে এমন একটা পার্টি, যে লড়বে এই সিস্টেমকে ব্যবহার করে যতদূর অব্দি অধিকার আদায় সম্ভব তা কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে এক সুবিশাল প্রস্তুতি নিতে, শোষনের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য।

 

অরিত্র বসু ‘পিপ্‌ল্‌স্‌ ব্রিগেড’ সংগঠনের সদস্য। 

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *