কিছু ছবি যা তুলে ধরে গোটা চিত্রটা
কলকাতা থেকে রেলপথে মাত্র ঘন্টা দেড়েকের দূরত্বে অবস্থিত বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মহকুমা শহর বসিরহাট, জেলা উত্তর ২৪ পরগণা। এবছর জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বসিরহাট মহকুমা সহ এই জেলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থ কাবা শরীফকে অবমাননা করে একটি ছবি পোস্ট করা হয়, বসিরহাটেরই পাশের একটি শহর বাদুড়িয়ার মাগুরখোলা গ্রামের একাদশ শ্রেণির শৌভিক সরকার নামে একটি ছেলের ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবিটি পোস্ট করা হয় বলে অভিযোগ। এরপর প্রথমে বাদুড়িয়া অঞ্চল এবং তা থেকে বসিরহাট শহরের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে যা কার্যত সাম্প্রদায়িকতার রঙ নেয়, যার নির্মম ফলশ্রুতি রূপে সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়, একাধিক মানুষ আজও নিখোঁজ, তার সাথে বহু কোটি টাকার সম্পত্তি নষ্ট হয়। বসিরহাট শহর কার্যত ৫-৬ দিন বাইরের অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে, সেই ইন্টারনেট পরিষেবা, যা থেকে এত কিছু, তার স্বাভাবিক হতে হতে ১৫ দিন কেটে যায়।
শৌভিক সরকারের বাড়ি
কিন্তু এই ঘটনা কি সত্যই একটা ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে তাতে নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের আবেগের ফলশ্রুতি ছিল? নাকি ছিল ঠান্ডা মাথায় ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে সেই মোতাবেক ঘটনাক্রমকে বাস্তবে রূপ দেওয়া? যে গুজবগুলি রটানো হচ্ছিল ওই সময়ে তা কে বা কারা কি উদ্দেশ্যে রটাচ্ছিল? ঘটনা আর রটনার কি কোনো সাযুজ্য ছিল? সেই উদ্দেশ্যে আমরা পিপলস ব্রিগেড আরো দুটি সংগঠন অল ইন্ডিয়া সেকুলার ফোরাম এবং সেন্টার ফর স্টাডি অফ সোস্যাইটি এন্ড সেকুলারিজম-এর সাথে যৌথভাবে একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং টিম তৈরি করি, যার উদ্দেশ্য ছিল এই ঘটনার ক্রম খোঁজা এবং তা অনুযায়ী ঘটনার উৎসে পৌছনো। আমাদের কাছে প্রশ্ন ছিল অনেক এবং এর উত্তর ছিল অনেকটাই অজানা। ইন্টারনেটে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধেয় মানুষ বা দেবদেবীকে অবমাননা করে এমন ছবির তো কমতি নেই, তাহলে কি করে একটা ছবিকে কেন্দ্র করে কিভাবে এত বড় একটা হিংসার ঘটনা ঘটে গেল, সবটাই কি স্বতঃস্ফূর্ততা? রাজনৈতিক ফায়দা লোটার প্রশ্ন কি এখানে অপ্রাসঙ্গিক? এই প্রশ্নগুলি আসতে বাধ্য কারণ ঐতিহাসিকভাবে যতগুলী এমন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে তার প্রতিটিতেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল তার ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণের স্বার্থকে পিছনে রেখেই ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করতে চেয়েছে।
বসিরহাটের ঘটনার সঠিক অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের কিছুটা পিছনে ফিরে যেতে হবে, কয়েকবছর আগে বসিরহাট থেকে ২০-২৫ কিলোমিটার দূরের একটি জনপদ দেগঙ্গাতেও এমন করেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, দেগঙ্গা বাজারের বেশ কিছু দোকান জ্বালিয়ে খাক করে দিয়েছিল কিছু উন্মত্ত দাঙ্গাবাজ। এই ঘটনা সংঘটনের তীর মুখ্যত ছিল বসিরহাটের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ হাজি নুরুল ইসলামের দিকে, এবং দ্বিতীয় নামটি ছিল আর এক তৃণমূল নেত্রী রত্না রায় চৌধুরী। নুরুলের প্রতি জনগণের ক্ষোভ এতটাই তীব্র ছিল যা ২০১৪-র লোকসভা ভোটে তৃণমূল তার এই জেতা সাংসদকে আর মনোনয়ন দেওয়ার সাহস দেখায়নি, যদিও তাঁর পরিবর্তে যিনি টিকিট পান তাঁর সাম্প্রদায়িক কুকীর্তির ইতিহাসও কম মণিমানিক্যখচিত নয় (জনাব ইদ্রিস আলি যিনি ২০০৭ সালে সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনকে ভারত থেকে বিতাড়নের কথা বলে লোক খেপানোর চেষ্টা করেন)।
সত্যের খোঁজে আমরা গিয়ে পৌঁছেছিলাম ফেসবুকে ঐ বিতর্কিত ছবিটি পোস্ট করার জন্য মূল অভিযুক্ত শৌভিক সরকারের গ্রাম বাদুড়িয়ার রুদ্রপুরের মাগুরখোলায়। শৌভিকের বাড়ির ঠিক বিপরীতে মসজিদ এবং পুরো গ্রামটাই হিন্দু ও মুসলিম জনবসতি মেশানো। শৌভিক যে বাড়িতে থাকত তার মাত্র হাতখানেক দূরত্বে দুজন কাঠের মিস্ত্রীর সাথে আমাদের কথা হয়; তাঁরা একই সাথে কাজ করেন একই দোকানে, একজন হিন্দু আর অন্যজন মুসলিম। আমরা যখন এলাকার মানুষদের সাথে কথা বলি তখন তাঁরা প্রত্যেকেই বলেন যে শৌভিক সরকারের বাড়ি যারা আক্রমণ করেন তাদের কাউকেই কস্মিনকালেও গ্রামে দেখা যায়নি এবং তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বাড়ি জ্বালানো ও এলাকায় অশান্তি ছড়ানো। এখানেই আসে সবথেকে বড় প্রশ্ন, ২ রা অগস্ট অর্থাৎ যে দিন পোস্টখানি করা হয় বলে অভিযোগ, তার মাত্র ৫-৬ ঘন্টার মধ্যে কিভাবে এত বড় সংখ্যক জমায়েত তৈরি হলো যার পুরোটাই বহিরাগত? কিভাবে তারা শৌভিকের গ্রাম শণাক্ত করে তার বাড়ি চিনে চলে এলো? কোনো সংগঠন বা রাজনৈতিক প্রকল্প ছাড়া এই ঘটনা কি আদৌ সম্ভব ছিল? আমরা কথা বলেছিলাম শৌভিকের এক জেঠার মেয়ের সাথে, সে বলে, যে ফেসবুক একাউন্ট থেকে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছিল সেই একাউন্টটি দীর্ঘদিন শৌভিক ব্যবহার করত না, তার বদলে সে অন্য একটা একাউন্ট খুলেছিল, তার তীর ছিল শৌভিকের অন্য একজন বন্ধু প্রীতম পালের দিকে। এর পাশাপাশি আরো একটা প্রশ্ন আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানুষের কাছে করেছিলাম, তা হলো যে পরিমান গ্রাফিকাল কারসাজি ছবিটিতে ব্যবহার করা হয়েছে তা রীতিমতো পেশাদারী, ফটোশপ বা ওই ধরণের কোনো সফটয়্যার ছাড়া তা করা অসম্ভব, প্রথম কথা হলো প্রীতম আর শৌভিক দুজনেরই বয়স ১৭-১৮ বছর, তাদের পক্ষে এটা করা কি আদৌ সম্ভব? তাহলে এর উৎস কোথায়? পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের কাছে তা অনুসন্ধান কোনো রকেট সায়েন্স তো নয় ! তাহলে তারা তা করছে না কেন?
আমাদের তিন দিনের অনুসন্ধানের প্রত্যেকটা পদক্ষেপে আমরা পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পেয়েছি। মাগুরখোলার ওই দুই কাঠমিস্ত্রীর বয়ান অনুযায়ী উন্মত্ত জনতা যখন শৌভিকের বাড়ি আক্রমণ করে তখন বাদুড়িয়া থানার একজন সাব-ইন্সপেক্টর সহ কয়েকজন পুলিশকর্মী পাশের বাড়ির উঠানে আশ্রয় নেয়। শুধু বাদুড়িয়াতেই নয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে যখন আমরা বসিরহাট শহরে অনুসন্ধানের কাজ করেছি তখনও একই কথা কানে আসতে থাকে। পরিস্থিতি যখন একেবারে আয়ত্বের বাইরে চলে যায় তখন পুলিশ কয়েকজন শাসকদলের নেতার নেতৃত্বে অতিসক্রিয়তা দেখায় যা পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তোলে। বাদুড়িয়া পুরসভার প্রাক্তন ভাইস-চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেন “পুলিশ মার খেয়েছে”। পুলিশ সুপারকে বাদুড়িয়ার মলয়পুরের কাছে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়।
আরাফাত ঘরামীর বাড়ি
৩রা জুলাই-এর পরে বাদুড়িয়াতে পরিস্থিতি প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসে কিন্তু এরপরেই দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে পড়ে বসিরহাট শহরে, বসিরহাটে উত্তেজনার সূত্রপাত হয় ত্রিমোহিনীর উল্টোরথের মেলা থেকে, যেখানে মেলার উপর কিছু সশস্ত্র দাঙ্গাবাজ আক্রমণ করে, এই কাজের জন্য মূল অভিযুক্ত হলো শাসকদলের এক নেতা মেজকাতুর (ওরফে মেজকার) যে বসিরহাটের তৃণমূলী গোষ্ঠীবিন্যাসে বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত, যদিও তৃণমূল নেতা অসিত মজুমদার কালিবাড়ির রথের মেলার ঘটনাটা কিছু “দুষ্টু প্রকৃতির লুঠবাজ” লোকের কাজ বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন। কালিবাড়ির রথের মেলা পণ্ড করেই “দুষ্টু প্রকৃতির লুঠবাজ” ছেলেরা শান্ত হয়নি, ঘটনাক্রমে সাম্প্রদায়িকতার রঙ গাঢ় করার জন্য ওই ওঞ্চলের একাধিক দোকান ভেঙে চুরমার করে দেয় তারা; এই তালিকাতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার চোখের হাসপাতালও আছে। এই ঘটনার পরে বসিরহাট শহরের একাধিক অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং তার সাথে শুরু হয় দাঙ্গাবাজদের দাঁত-নখ বের করা আক্রমণ। একাধিক অঞ্চলে মানুষের বাড়িঘর আক্রান্ত হয় এবং সাম্প্রদায়িকতার রঙ চড়াতে দুই সম্প্রদায়েরই কিছু পাকা মাথা আসরে নেমে পড়েন। বসিরহাট রেলস্টেশন সংলগ্ন মায়ের বাজারে বেছে বেছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের দোকান ভাঙা হয়, ষড়যন্ত্র করে স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলের একটি কালি মন্দিরের উপর আক্রমণ করা হয়। পশ্চিম দন্ডীরহাটে একাধিক মুসলিম পরিবার প্রাণসংশয়ে ঘরছাড়া হয়। বসিরহাটের একাধিক জায়গায় নিরীহ মানুষ আক্রান্ত হয় উন্মত্ত ঐ দাঙ্গাবাজদের দ্বারা।
আমাদের কাজের প্রথম দিন আমরা দু’জন আক্রান্তের বাড়ি যাই; তাদের নাম রিয়াজুল মোল্লা এবং আবু তালেব। রিয়াজুল পেশায় মাছ বিক্রেতা এবং আবু তালেব ভিনরাজ্যে দর্জির কাজ করেন; ছুটিতে বাড়ি এসেছিলেন। রিয়াজুলকে বসিরহাটের মৈত্রবাগান এলাকায় এবং আবু তালেবকে বসিরহাটের হরিশপুর মোড় সংলগ্ন এলাকায় বাঁশ, লাঠি, রড দিয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করা হয়। রিয়াজুলের মাথায় ২২টি সেলাই পড়ে, ডান পা মেরে ভেঙ্গে দেওয়া হয়। আর অন্যদিকে আবু তালেবকে বিবস্ত্র করে দেহের একাধিক জায়গায় আঘাত করা হয়। দুজনেই এখনো শয্যাশায়ী। দাঙ্গার সময় বসিরহাটের হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলগুলিতে প্রচার করা হয় এরা নাকি দাঙ্গাবাজ, রিয়াজুলের বাড়ি গিয়ে আমরা দেখি তার দুটি কন্যাসন্তান, তাদের একটি সদ্যোজাত। এদেরকে কোনোরকম ন্যুনতম সরকারী সাহায্য প্রশাসন করেনি, কেবল যখন অর্ধমৃত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে ছিলেন, তখন তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা ছাড়া। বসিরহাট গাঁড়াকুপির আরাফাত ঘরামীর বাড়িতে পৌঁছাই আমরা। পেশায় সাইকেল মিস্ত্রী আরাফাত গোলমালের দিনে সাইকেলের দোকানের পাইকারি জিনিস কিনতে গেছিল বসিরহাট শহরে, তারপর থেকে সে নিখোঁজ; আরাফাতের বাড়ির লোক একাধিকবার হাসনাবাদ থানা, মর্গ, হাসপালে গেলেও তার কোনো খবর আজও মেলেনি।
আরাফাত ঘরামীর পরিবারের উদ্বিগ্ন সদস্যরা
এরপর আমরা যাই বসিরহাটে ট্যাঁটরা অঞ্চলে কার্তিক ঘোষের বাড়িতে, যিনি এই দাঙ্গায় নিহত হন। তাঁর ছেলের সাথে আমাদের কথা হয়। তিনি বলেন, ৫ই জুলাই বুধবার সকাল সাড়ে এগারোটা-বারোটার সময় কার্তিকবাবু ভাবানীপুর-নপাড়ার দিক থেকে আসছিলেন ট্যাঁটরাতে, সেই সময় পাইকপাড়ায় অশান্তি হচ্ছিল। কার্তিকবাবু এলাকার স্থানীয় লোক এবং তিনি ভাবেন এলাকার মুসলিমরা তার চেনাশোনা লোক; ফলে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা তিনি করেননি। কয়েকজন উন্মত্ত আক্রমণকারী (সম্ভবত এলাকার নয়) তাঁর উপর ভোজালি দিয়ে আক্রমণ করে। কার্তিকবাবু আক্রান্ত হবার খবর তাঁর বাড়িতে আসে বেলা দেড়টা-দুটোয়। খবর পেয়েও বাড়ির কেউ প্রথমে আক্রান্ত হবার ভয়ে যেতে পারেননি। পরে কার্তিকবাবুর ছোটোছেলে পুলিশকে ফোন করে ও এম্বুলেন্স জোগাড় করে তাঁকে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান। বসিরহাট হাসপাতাল থেকে কার্তিকবাবুকে রেফার করা হয় কলকাতায় আর জি কর হাসপাতালে। কার্তিকবাবুকে নিয়ে যাওয়ার সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলেন আর একজন আহত ফজলুর সর্দারকে (এনার কাছে আমরা পরবর্তীতে যাই ও কথা বলি) একই সাথে নিয়ে যেতে, মানবিকতার খাতিরে কার্তিক ঘোষের পরিবার তাঁকে আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে যান এবং ভর্তি করে সিটি স্কান করান, ওষুধ কিনে দেন। তখন ফজলুর সর্দারের বাড়ির কেউ ছিলেন না। রাত সাড়ে এগারোটার পর ফজলুর সর্দারের জামাই হাসপাতালে আসেন। ৬ই জুলাই, বৃহস্পতিবার কার্তিক ঘোষ মারা যান। কার্তিকবাবুর ছেলেকে যখন আমরা ফজলুর সর্দারের কথা জিজ্ঞেস করি তখন তিনি বলেন, উনিও আহত আমার বাবাও আহত, এটা আমার কাছে তখন মানবিকতার প্রশ্ন ছিল, সে হিন্দু না মুসলমান তখন আমার মাথায় ছিল না। এই কার্তিকবাবুর মৃত্যুর পর বিজেপি তার দেহ দখল করে নোংরা রাজনীতি করতে গেছিল, কিন্তু তাঁর ছেলেরা রুখে দাঁড়ান। এ-ই যেখানে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, সেখানে বাইরে থেকে ঘৃণ্য স্বার্থে চক্রান্ত করে ছাড়া আর কোনও ভাবে দাঙ্গা হওয়া সম্ভব !
হাসনাবাদ থানায় আরাফাতের পরিবারের দায়ের করা অভিযোগ
আমরা কথা বলেছিলাম বসিরহাট মাওলানাবাগ দরবার শরীফের ধর্মগুরু কারফুল আমিনের সাথে। এই জায়গাটা স্থানীয় মানুষের কাছে হুজুরের বাড়ি নামে পরিচিত। এখানে ফুরফুরা শরীফের সাথে সম্পর্ক রেখে একটি সংগঠন চলে যার নাম হলো আল্লামা রুহুল আমিন ফাউন্ডেশন (আরফ) যাদের কাজ মূলত সমাজসেবামূলক। বসিরহাটে এদের মুসলিম সমাজের মধ্যে একটা বিরাট গ্রহণযোগ্যতা আছে। কারফুল আমিনকে আমরা জিজ্ঞাসা করি আপনি তো ইন্টারনেট বা ফেসবুক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তাতে মুসলিমদের নবি, হিন্দু দেবদেবী বা যীশুকে অপমান করে এরকম বহু পোস্ট আছে। কিন্তু এরকম একটা ছবি নিয়ে কিভাবে এত বড় একটা ঘটনা হলো? উত্তরে তিনি বলেন, মানুষের ধর্মীয় আবেগকে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। এরপর আমরা কারফুল আমিনের ছেলের সাথে কথা বলি যিনি আলামা রুহুল আমিন ফাউন্ডেশন-এর ডিরেক্টর। তিনি আমাদের একটা নতুন তথ্য দেন। তা হলো সৌভিকের জেঠার বাড়ির পাশে যে মসজিদ আছে সেখানে আজান দেবার মাইক লাগানো নিয়ে শৌভিকের জেঠার সাথে মসজিদ কমিটির কোনো গোলমাল হয় বছর তিনেক আগে। গোলমাল খুব সামান্যই ছিল। কিন্তু বাদুড়িয়া এলাকার তৃণমূল নেতা মন্টু হাজি বিষয়টির ফায়দা তুলতে চেয়েছিলেন, এবং এও বলেন যে মাইক তিনি তুলেই শেষ দেখবেন। তিনি এরপর আরো একটি তথ্য দেন যে তাঁর উপস্থিতিতে একটি শান্তি বৈঠক হচ্ছিল সেখানে তিন জন আইপিএস অফিসার ছিলেন। বাদুড়িয়ার গন্ডগোল সেদিন মিটে যেত। আচমকা মন্টু হাজি ঢুকে আইপিএস অফিসারদের একজনকে ফোন দিয়ে বলেন, দাদার ফোন (দাদা বলতে তিনি মুকুল রায়-এর কথা বলেন যিনি তখনও তৃণমূল নেতা, আর কয়েক মাস পরই স্থান নিলেন বিজেপিতে। বৈঠক থেকে আর কোনো রফাসূত্র বের হয় নি; পরের দিন থেকে দাঙ্গার আগুন ফের জ্বলতে শুরু হয়)। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে সরকার বা প্রশাসন কি আরো ইতিবাচক হতে পারত? তাঁর জবাব অবশ্যই পারত। পুলিশকে প্রথম দিকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। খোবায়েব আমিন এরপর আমাদের একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের ভিডিও দেখান যেখানে আবদুল মাতিন, কামরুজ্জামানের মতো আরো কয়েকজন তৃণমূল নেতাকে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়ানোর জন্য উস্কানিমূলক কথা বলতে দেখা যায়।
আহত রিয়াজুল মোল্লাহ
বসিরহাটে এই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছে সীমান্ত অঞ্চলের গরু পাচার অর্থনীতি ও তার ভাগ বাঁটোয়ারা। গরু পাচার থেকে এক বিপুল পরিমাণে ‘তোলা’ আসে তৃণমূলের তহবিলে; বিজেপি-র নজর ঐ টাকার দিকে। বসিরহাট অঞ্চলে একাধিক তৃণমূল নেতার সাথে বিধায়ক দীপেন্দু বিশ্বাসের এ নিয়ে বিরোধ আছে, যার মধ্যে নারায়ণ গোস্বামী এবং অসিত মজুমদারের নাম সবার আগে আসে। মুখ্যমন্ত্রীও একবার প্রশাসনিক সভায় দুজনকে গোলমাল মিটিয়ে নিতে বলেন, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি না করে পাচারের টাকার ভাগ-যোগ গুলো সব আলোচনা করে চালাও, এই ছিল তাঁর বার্তা। কিন্তু পরিস্থিতি দিনের পর দিন আরো ঘোরালো হয়েছে। এই ঘটনার প্রায় মাসছয়েক আগে বসিরহাটে রবীন্দ্রভবনে একটি সভাকে কেন্দ্র করে বিধায়ক অনুগামী এবং বিধায়ক বিরোধী দুই পক্ষের তুমুল মারামারি হয়। ঘটনায় বিধায়ক বিরোধী গোষ্ঠীর এক তৃণমূল নেতা সুরজিত মিত্র ওরফে বাদল গুরুতর আহত হন, তখন বসিরহাটের ‘কংগ্রেসের শেষ কথা’ বলে পরিচিত অসিত মজুমদার সবে সবে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। বসিরহাট রেলস্টেশনের কাছে একটি রিফিউজি হিন্দু পাড়া আছে যার নাম গোডাউন পাড়া, এখানে কিছু ছেলেকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে দীপেন্দু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এলাকার সাধারণ মানুষ ক্ষোভ উগরে দেন, যার প্রেক্ষিতে দীপেন্দুকে সরিয়ে দেওয়া হয় তৃণমূল থেকে, ক্ষমতা দখলের রাজনীতি আবারও সামনে আসে এই ঘটনার পরে অসিত মজুমদারের প্রভাববৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে।
আক্রান্ত আবু তালেব
বসিরহাট-বাদুড়িয়ার সাম্প্রতিক এই দাঙ্গার ঘটনাগুলির অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রতি পদক্ষেপে আমরা শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের পদচিহ্ন পেয়েছি, যার সাথে তলায় তলায় বিজেপি-র নানা প্রকার গভীর যোগসাজশ (মুকুলের কথাটা মনে করুন); এবং কোনোভাবেই মনে হয়নি যে দুটি সম্প্রদায়ের সাধরন মানুষ তাঁদের পরস্পরের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে এই ঘটনার রূপ দিয়েছেন। পুরো ঘটনাপ্রবাহ জুড়ে পুলিশকে অস্বাভাবিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল, একেবারে ঘটনা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার পর আধাসেনা নামানো হয়েছিল। যে বসিরহাটে তৃণমূলের এত প্রভাব, সেখানে মুখ্যমন্ত্রীকে কেন প্রেস কনফারেন্স করে বলতে হয় এই সব ঘটনা তাঁকে দুই রাত ঘুমাতে দেয়নি? কুম্ভীরাশ্রু !
কিংশুক চক্রবর্তী ‘পিপ্ল্স্ ব্রিগেড’-এর সদস্য।