ত্রিপুরা নির্বাচনের ফলাফল ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে আপাত দৃষ্টিতে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন নজির। “২০ বছর এক দলের সরকার চলার পর রাজনৈতিক পালাবদল”, – মিডিয়ার প্রচার এমনটাই; এমন কি সিপিআই(এম)-এর মুখপত্র গণশক্তির বয়ানও ঠিক সেইটেই। অথচ এই রাজ্যের এতদিনের সরকারের বিরুদ্ধে কোনও বিশেষ ক্ষোভের কথা আজ অব্দি শোনা যায়নি; বরং মানব উন্নয়ন সূচক-এর বিভিন্ন দিকগুলিতে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির থেকে তো বটেই, এমনকি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেশের গড়ের থেকেও অনেকটাই ওপরে স্থান করে নিয়েছে সে; পশ্চিমবাংলা ও কেরলে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে চলা সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরণের অভিযোগ ছিল ও আছে, ত্রিপুরায় তেমন উদাহরণও নেই; নয়া-উদারবাদের জনবিরোধী নীতিগুলি সরকার উদ্ধতভাবে প্রয়োগ করেছে, তেমনটাও নয়; বড় কোনও দুর্নীতি বা দুষ্কৃতিরাজের দৌরাত্ম্যর বিষয়ে সরব হতে দেখা যায়নি কোনও মহলকেই; বিপরীতে বাজারী মিডিয়া পর্যন্ত তুলে ধরতে বাধ্য হয়েছে ২০ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর কমরেড মানিক সরকারের মোট হাজার দু’এক টাকার ব্যাংক ব্যালান্স-এর কথা। এমন একটা দল সরকার থেকে চলে গেল ! মাত্র তিন মাস আগেও যে দলের টিকি দেখা যেত না, ভোটের আগে প্রচারের বিন্দুমাত্র ঝড় তোলার চেষ্টা পর্যন্ত যারা করেনি, অকস্মাৎ তারাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হল ! ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে যখন গেরুয়ার জয়-জয়াকার, গোটা দেশে সিপিআই(এম)-এর ভোট ৫%-এর কম, তখনও যারা ত্রিপুরায় ৬৪% ভোট পেয়েছে, কী এমন ঘটলো যার জন্য ২০% ভোট কমে তারা আজ গদিচ্যুত ! সবচেয়ে মজার কথা হল, স্বাভাবিক প্রবণতা হল এইটাই যে, যেখানেই আর যখনই একটা দীর্ঘকালীন সরকারের পতন হয়, সেখানেই আর তখনই ‘ভোটার টার্ন আউট’ গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণে বাড়তে দেখা যায়; কিন্তু বর্তমান ত্রিপুরা নির্বাচনে প্রায় ১০% ‘টার্ন আউট’ কমে গিয়েও পালাবদল ঘটে গেল ! ‘সরকার বদলানো’ কি জনগণের জন্য সকালে উঠে ‘পোশাক বদলানো’-র মতো ব্যাপার ! কোনোভাবেই একে তাই “রাজনৈতিক পালাবদল” মাত্র বলে চিহ্নিত করে দায় সারা যায় না। আর “সবকিছু টাকার খেলা” বলে যাঁরা বিষয়টির গুরুত্বকেই লঘু করে দিতে চাইছেন, তাঁরা জনগণের লড়াইয়ের চরমতম শত্রু; কারণ বুর্জোয়া দলগুলো তাদেরই সিস্টেমে “টাকার খেলা” খেলবে না (!), এ তো শিশুর আবদার; আর তাতেই যদি লড়াইয়ের সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন, তো হিমালয়ে গিয়ে সন্ন্যাস নেওয়াই আপনাদের একমাত্র অভীষ্ট, আপনারা সচ্যালাবলে কম্বল-গাড়ু নিয়ে সেখানেই গিয়ে বরং হাজির হোন।
ত্রিপুরার কমরেডদের সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি হল খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জন্ম নেওয়া এক গভীর রাজনৈতিক সুবিধাবাদ। গত এক দশক ধরে সিপিআই(এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি সহ সর্বত্র, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল ইউনিটের নিজেদের মধ্যে ও পরস্পরের মধ্যের বিতর্কের ঘূর্ণাবর্তে, তাঁরা অদ্ভুত এক মৌনব্রত পালন করে এসেছেন। ভাবটা ছিল এমন, যেন, ত্রিপুরায় এক শান্তিপূর্ণ ঐক্য বিরাজমান, খামকা বিবাদ ডেকে এনে লাভ কী ! তাঁরা বুঝতেই পারলেন না যে এই বিতর্ক কোনও নিছক পণ্ডিতি তর্কের ব্যাপার নয়, এ হল বর্তমান ভারতের সমাজের বিবাদমান শ্রেণীগুলোর দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ, যা দুনিয়াব্যাপী নয়াউদারবাদী সংকট থেকেই জন্ম নিচ্ছে। এই বিতর্ক তাই কখনও সিপিআই(এম)-এর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার মাত্র হয়ে থাকেনি; শুধু বিভিন্ন রাজনৈতিক দলই নয় এমন কি সমাজের বিভিন্ন অংশের জনগণও সেসব প্রসঙ্গে নানা উপায়ে তাঁদের মত ব্যক্ত করেছেন। আজ সামগ্রিক ভাবে দেখলে সিপিআই(এম)-এর এই অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব কার্যত অসমাধানযোগ্য এক সমস্যায় পরিণত হয়েছে, খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গিতে যা দেখা সম্ভব নয়। পশ্চিমবাংলায় ‘সেজ্ আইন’, শিল্পায়নের সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম লাইন, পরমাণু চ্যুক্তির বিরোধিতায় সমর্থন প্রত্যাহার অথচ কোড়ানকুলাম-এ নিরবতা, সর্বহারার একাধিপত্যের লক্ষ্যে ঢোঁক গেলা, ‘বাজার সমাজতন্ত্র’-এর হাঁসজারু মডেল, কংগ্রেসের সাথে নির্বাচনী জোট না করার সিদ্ধান্ত কিন্তু পশ্চিমবাংলায় তা করার পরেও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ পর্যন্ত অস্বীকার, এবং সর্বোপরি, ‘নয়া-উদারবাদ’-কেই লড়াইয়ের প্রধান টার্গেট হিসাবে চিহ্নিত করা তার কোনও ব্যাখ্যামূলক দলিল ছাড়াই, অর্থাৎ এক কথায় ‘ছায়ার সাথে যুদ্ধ’, – সব মিলিয়ে গত এক দশকে সিপিআই(এম)-এর গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নেতৃত্বের নির্বাচন এবং বাস্তব ক্রিয়াকলাপ একটিও অন্যটির সাথে খাপ খায়নি। সে আজ ‘সেল্ফ্-ট্র্যাপ্ড্’। আর সে টাইটানিক যখন ডুবছে, আপনারা তখন ভায়োলিন বাজাচ্ছেন, সে আপনাদের সংগ্রামের গান হতে পারে না, আপনারা শান্তিতে বসে বিদায়সঙ্গীত বাজাচ্ছিলেন।
২০১৪-র নির্বাচনের প্রেক্ষিত গোটা দেশেই ছিল এক ও অভিন্ন – কংগ্রেস হটাও। তখনও পর্যন্ত নয়া-উদারবাদের মুনাফা-হাঙ্গর প্রবৃত্তিতে দুর্নীতির পাহাড় গড়তেই দেখেছে দেশের মানুষ। যে যেখানে কংগ্রেসকে হটাতে বিশ্বাসযোগ্য শক্তি, মানুষ সেখানেই তাকেই ঢালাও সমর্থন দিয়ে জিতিয়েছে। ত্রিপুরাতে তাই দুটি সিটই জেতে সিপিআই(এম)। কিন্তু গত তিন চার বছর দেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সেখানেই আটকে থাকেনি। ২০০৮-এর অর্থনৈতিক মন্দার কথা সকলেই বলেন, কিন্তু খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই যেটা অগোচরে থেকে গেছে তা হল পালা করে করে প্রায় ৮-৯ বছর অন্তর চক্রাকারে আসা নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সংকট; যার ‘এপিসেন্টার’ এক শক্তিধর দেশ থেকে পরের চক্রে পৌঁছচ্ছে অন্য আরেক শক্তিধর দেশে, আর প্রতিবার সে সংকটের মাত্রা আগের বারকে ছাপিয়ে যাচ্ছে; আজকের দুনিয়ার যে সাত-আটটি শক্তিধর দেশ নয়া-উদারবাদের যুগে টেনে এনেছে আরও প্রায় আড়াই’শ দেশকে, তাদের সাথেই ‘ফরেন ট্রেডিং’-এর জটিল এক নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে আর্থিক সংকটের এই পাচার চলছে; আর তার সাথে তাদের মাঝে পড়ে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে অসংখ্য এই ছোট ও মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলি। এ সংকট উড়ে বেড়িয়েছে ১৯৯২-এ জাপান থেকে ২০০০-এ ইউ.এস-এ, ২০০৮-এ ইউ.এস ও ইউরোপে, এবং সাম্প্রতিক ২০১৫-১৬-এ চীন ও ইউ.এস-এতে। এই সাম্প্রতিকতম স্টক মার্কেট সংকটের আবর্জনার এক স্তূপ এসে জমা হয় এদেশে, কারণ ভারত সবচেয়ে বেশি আমদানি করে চীন থেকে (১৫%) ও সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে ইউ.এস-এতে (১৫%), ফলে ‘সোর্স আর ড্রেন’-এর ঝঞ্ঝা ‘চ্যানেল’-এ এসে আটকে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাজারের সুস্থিতির অপেক্ষাতেই গোটা দেশ থেকে ৮৬% অর্থ, কালো টাকা উদ্ধারের মিথ্যা প্রচারে, বলপূর্বক, তুলে নিতে বাধ্য হয় মোদী সরকার, এবং তার সিংহভাগ জমা রাখা হয় রিজার্ভ ব্যাংকের ‘মার্কেট স্টেবিলাইজেশন স্কিম’-এর খাতে, আজও যাতে দেশের জনগণের ১ লক্ষ কোটি টাকা মজুত রয়েছে কর্পোরেটদের মুনাফায় যাতে ঘাটতি না হয়, সেই লক্ষ্যে। কিন্তু তাতেও ফল দাঁড়ায় আরও ভয়ানক; গোটা দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রে ধ্বস নামে, বিশেষত কৃষিক্ষেত্রে। স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রতিটা কোনায় সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যাবলীর স্থানীয় চরিত্রকে বহু পিছনে ফেলে নয়া-উদারবাদের এই সঙ্কটই জনজীবনের প্রধান সমস্যা হয়ে ওঠে। এ এক চরম বৈপ্লবিক সংকটের রূপ ধারণ করছে প্রতিদিন। বামপন্থীরা এই পরিস্থিতিতে বিপ্লবী ভূমিকা পালন না করলে চরম দক্ষিণপন্থীরা এই শূন্যস্থান পূরণ করবেই, এ এক ঐতিহাসিক সত্য। গত দুই-তিন বছরে দুনিয়ার দেশে দেশে যে উগ্র দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট্ চরিত্রের পার্টিগুলির ব্যাপক শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে, তা কমিউনিস্টদের অবিপ্লবী ও বিপ্লব-বিরোধী ভূমিকার এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক চরিত্রের প্রলেপীয় রাজনীতির দউলতেই। ভারতেও সিপিআই(এম) সহ কমিউনিস্ট নামধারী সবকটি দলই কার্যত এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকাই পালন করেছে। ফ্যাসিবাদের উত্থানের প্রায় এক দশক আগে ১৯২৪ সালে কমরেড স্তালিন ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন, “ফ্যাসিবাদ বুর্জোয়াদের যুদ্ধংদেহী সংগঠন যা আদতে দাঁড়িয়ে থাকে সোশ্যাল ডেমক্র্যাসির সক্রিয় সমর্থনের ওপর ভিত্তি করেই। সোশ্যাল ডেমক্র্যাসি বস্তুগত ভাবেই ফ্যাসিবাদের নরমপন্থী উইং। … এই সংগঠনগুলি পরস্পরকে খারিজ করে না, সম্পূরণ করে। তারা বিপরীত গোলার্ধের নয়, তারা যমজ”।
সরাসরি বিজেপি দলের পক্ষ থেকে বর্তমানে ভারতের ১৫ টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং এর মধ্যে ১৪ জন ২০১৪-র পর নির্বাচিত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৯ জন আবার এসেছেন গত, মাত্র, এক বছরের মধ্যে। একাধিক আঞ্চলিক দলের অস্তিত্ব প্রায় অবলোপের পথে চলে গেছে। যাঁরা রাজ্যের ক্ষমতায় এখনও আছেন, তাঁদের মধ্যে নিতিশ কুমার ইতিমধ্যেই বিজেপির সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছেন, আর সকলেই জানেন যে আপ, তৃণমূল কংগ্রেস, বিজেডি ও এআইডিএমকে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। অন্যদিকে মাত্র ৪টি রাজ্যে কংগ্রেস সরকার। অর্থাৎ সমস্ত রাজ্যের জনগণের আঞ্চলিক সমস্যাগুলি অতীব লঘু হয়ে গেছে আর্থিক সংকট সৃষ্ট সীমাহীন যন্ত্রণার কাছে, তাই আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি তাঁদের যন্ত্রণায় মলমটুকুও লাগাতে যে একান্তই অক্ষম, তা মানুষের কাছে পরিষ্কার। সমস্যার উৎসের কাছেই তাই সন্ধান খোঁজার চেষ্টা। কথায় বলে, “দিল্লী বহুত দূর”; তাই সমস্যার কেন্দ্রকে সুদূর থেকে নিজেদের আয়ত্তের সীমায় আনতে চাইছেন মানুষ, অন্তত আবেদন-নিবেদনটুকুও যাতে পৌঁছে দেওয়া যায়; যতটুকুই পাওয়া যাবে তাও তো আঞ্চলিক দলগুলির ক্ষমতার বাইরে, এই তাঁদের গোদা চিন্তা। বোঝা প্রয়োজন, এটি খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি নয়, সামগ্রিক ভাবনা।
অন্যান্য রাজ্যে নিজেদের কমরেডদের আন্দোলন চলুক বা তাঁদের ওপর আক্রমণ, দায় সারা আনুষ্ঠানিক সংহতি গ্যাপনই সিপিআই(এম)-এর সমস্ত রাজ্য ইউনিটগুলিরই সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। আর ত্রিপুরার কমরেডরা তো তাঁদের রাজ্যে সিপিআই(এম)-কে বিবাদ-বিসংবাদহীন একটি আঞ্চলিক দলেই পরিণত করে ফেলেছিলেন। সুতরাং তাঁদের ভাগ্যও খণ্ডিত সত্যের মুখ দেখেনি, দেশের বাকি সব আঞ্চলিক দলের পরিণতিই তাঁদের ভাগ্যেও জুটল।
আসলে খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গিই মার্কসবাদীদের সবচেয়ে বড় বিচ্যুতি। আজকের ফ্যাসিবাদী উত্থানকে রুখতে চাই, এই আর্থিক সংকটকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে গোটা দেশব্যাপী এমন এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান।
বাসুদেব নাগচৌধুরী পিপ্ল্’স্ ব্রিগেড সংগঠনের আহ্বায়ক।
Khub relevant lekha …