গত ২১ শে ডিসেম্বর সিবিআই-এর বিশেষ আদালতের রায়ে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের আমলের টুজি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির অন্যতম অভিযুক্তদের বেকসুর খালাসের মধ্যে দিয়ে, দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কংগ্রেস ও তার ‘অনুজ-প্রতিম’ আঞ্চলিক দলগুলির ‘স্বচ্ছতা’-র এক নয়া প্রচার শুরু হয়েছে; আগামীদিনে দেশের রাজনৈতিক সমীকরণ নির্মানে যা এক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে নিঃসন্দেহেই, বিশেষত যেখানে মাত্র দেড় বছরের মাথাতেই দেশের বৃহত্তম নির্বাচনী সংগ্রাম অপেক্ষা করছে। তামিলনাড়ুর সাংসদ এবং ডিএমকে নেতা করুনানিধির কন্যা কানিমোঝি বা প্রাক্তন টেলিকম মন্ত্রী এ. রাজা-র মত হেভিওয়েট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যখন দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর হাজতবাস থেকে রেহাই পেলেন, এবং তা আবার ‘বেকসুর’ তকমা সহ; তখন অভিযোগটা আসলে ঠিক কী ছিল, আর কারা কারা কীভাবে ঘটনায় যুক্ত ছিল এবং কীভাবে সেই অপরাধ জনগনের বাঁচা-মরার সাথে সম্পর্কিত, তা খুলে বিশ্লেষন করাটা দেশের বামপন্থী কর্মীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কারণ আদালত ‘বেকসুর’ বলে রায় দিলেও জনগণকে ঠিক করতে হবে তাঁরা এদের ‘বেকসুর খালাস’ করবেন কিনা !
।। ১।।
গোটা ঘটনার সূত্রপাত ২০১১ সালে যখন টেলিকম পরিষেবা ছিল ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহত্তম অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির একটি, যার তদানীন্তন মাসিক গ্রোথ রেট ১.১% এবং বার্ষিক রেভিনিউ-র পরিমান ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
১৯৯৪ সাল থেকে টেলিকম সার্ভিসের ক্ষেত্রে বেসরকারি কোম্পানিগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হলেও, ১৯৯৯ এবং ২০০২ সালের সার্ভিস-দাতাদের সংখ্যাসীমা সংক্রান্ত আইনের কড়াকড়ি কিছুটা হ্রাস পেতেই টেলিকম ক্ষেত্রের প্রকৃত গ্রোথ শুরু হয়, যা ছিল টেলিকম সার্ভিসে রাষ্ট্রীয় একচেটিয়ার পরিবর্তে বেসরকারী ‘অলিগোপলি’-র দিকে যাত্রা এবং ক্রমেই ২০০৬ সাল নাগাত দেশের মোট সার্ভিসদাতা কোম্পানীর সংখ্যা হয়ে দাঁড়ায় ১০, যেখানে দেশের গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিওন, যা কার্যত এক্সপোনেনশিয়ালি বাড়তে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই টেলিকম, দেশের পুঁজিপতিদের জন্য বিনিয়োগের এক আকর্ষনীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠতে থাকে, বিশেষত যখন ভারত দুনিয়ার মধ্যে সবচাইতে কম দামে মোবাইল ফোন পরিষেবা দিচ্ছিল (০.০০৭ মার্কিন ডলার/মিনিট)।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী টেলিকম পরিষেবা প্রদানের জন্য কোম্পানীগুলির একটি লাইসেন্সের প্রয়োজন হয় যার ভিত্তিতে তারা স্পেকট্রামগুলি ব্যবহার করতে পারে। ২০০৭ সালে ডিপার্টমেন্ট অফ টেলিকমিউনিকেশন্স্ (ডট), স্পেকট্রামগুলির বরাতজনিত নতুন লাইসেন্স নীতি চালু করে, যা নতুন নতুন কোম্পানীগুলিকে টেলিকম ক্ষেত্রে প্রবেশ করার সুযোগ করে দেয়। সে বছর, অক্টোবরের মধ্যে ডটের কাছে ৪৬ টি কোম্পানী থেকে মোট ৫৭৬ টি অ্যাপ্লিকেশন জমা পড়ে। টেলিকম রেগুলারিটি অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া পরামর্শ দেয় যে, প্রদত্ত ‘এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া’ পূর্ন করছে, এমন সবকটি কোম্পানীকেই যেহেতু লাইসেন্স দিতে হবে, স্পেকট্রামের পরিমান সীমিত হওয়ায় একটি রেশনিং পদ্ধতি চালু করা সেক্ষেত্রে আবশ্যক।
তদানীন্তন টেলিকম মন্ত্রী এ. রাজার তত্ত্বাবধানে লাইসেন্স প্রদানের এই গোটা প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃত বাজার দাম কী হতে পারে, সেই সংক্রান্ত কোনও ধরণের গবেষনা না করেই, জানুয়ারী ২০০৮-এ লাইসেন্সগুলি বিক্রী করা হয়, ২০০১ সালের জুন মাসের দামে। দেশের ২২ টি স্পেকট্রাম রিজিওনের মধ্যে ১৭ টি কোম্পানীকে মোট ১২২ টি লাইসেন্স দেওয়া হয়। সিএজি-র তথ্যানুসারে এগুলির মধ্যে ৮৫ টি লাইসেন্স এমন এমন কোম্পানির হাতে গেছে, যারা ডট প্রদত্ত ‘এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া’ পূর্ন করতে ব্যর্থ ¾ এদের মধ্যে কয়েকটির ‘কোর’ ব্যবসা ঠিক কি তা স্পষ্ট পর্যন্ত নয়, অনেকগুলির এমনকি প্রয়োজনীয় মূলধনই নেই।
সবচাইতে ভয়ানক দিকটা হল, সমস্ত কোম্পানিগুলিই এই লাইসেন্সগুলি অর্জন করে ব্যপক মাত্রায় কম দামে। উদাহরণ হিসেবে স্যান টেলিকমের নাম করা যায়; ১৩ টি লাইসেন্সের জন্য ৩৮৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিলেও, প্রাপ্ত স্পেক্ট্রামের ৫০% ইক্যুইটি এরা ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে বেচে দেয়! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সোয়ান টেলিকম, ইউনিটেক এবং টাটা টেলিসার্ভিসেস তাদের শেয়ার যথাক্রমে এটিস্যালাট, টেলিনর ও ডোকোমোকে বেচে দেয়।
সিএজি-র নির্ধারিত ২০১০ থ্রিজি এণ্ড বিডব্লিউএ স্পেক্ট্রাম-নিলাম দামের ভিত্তিতে করা হিসেবে, অবশ্যপ্রাপ্য অর্থ ও প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে ব্যবধান ছিল ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যদিওবা তদানীন্তন ইউপিএ সরকারের অধীনস্থ সিবিআই-এর দায়ের করা চার্জশিটে (২রা এপ্রিল, ২০১১) বলা ছিল, ক্ষতির মোট পরিমাণ ৪.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার!
২০১২ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি টুজি স্পেকট্রাম সংক্রান্ত একটি পিআইএল-এর রায়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পেকট্রাম-এর বরাত দেওয়ার এই গোটা ঘটনাটিকে “আনকন্সটিটিউশনাল এণ্ড আর্বিটারি” বলে অভিহিত করে; এবং ১২২ টি স্পেক্ট্রাম লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
এই গোটা ঘটনায় আর একজন হেভিওয়েট ডিএমকে নেত্রীর নাম উঠেছিল – এম.কে. কানিমোঝি। করুনানিধির পারিবারিক চ্যানেল কালাইগ্নর টিভিতে কানিমোঝির স্টেক ২০%, এবং তাঁর মা দয়ালু আম্মালের স্টেকের পরিমান ৬০%। সিবিআই-এর দাখিল করা চার্জশিটে দেখানো হচ্ছে যে, এই চ্যানেলের অপারেশনের পিছনে কানিমোঝি “অ্যাক্টিভ ব্রেন” হিসেবে কাজ করেছেন। চার্জশিটে সিবিআই জানাচ্ছে যে, সোয়ান টেলিকমকে লাইসেন্স দেওয়ার বিনিময়ে ২০০ কোটি টাকার ঘুষ নেন কানিমোঝি, যা সিনেযুগ মিডিয়া এণ্ড এন্টারটেইনমেন্ট এবং কুসেগাঁও ফ্রুটস এন্ড ভেজিটেবলস মারফৎ ঘুরপথে কালাইগ্নর টিভিতে ঢোকে। ফলে কানিমোঝি ছাড়াও এই গোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে কালাইগ্নরের ডিরেক্টর শরদ কুমার, সিনেযুগের করিম মোরানি, এবং কুসেগাঁও-এর আসিফ বালওয়া এবং রাজীব আগরওয়ালের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে সিবিআই। এঁদের মধ্যে কানিমোজি, শরদ এবং মোরানি ২০১১-এর ২৫ শে এপ্রিল গ্রেপ্তার হন, যার ঠিক চার দিন আগেই গ্রেপ্তার হন আসিফ এবং রাজীব।
এরই মধ্যে সামনে চলে আসে ২০০৮-০৯ সালে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের করা একটি কল রেকর্ড থেকে বৈষ্ণবী কমিউনিকেশনস নামের একটি কোম্পানীর কর্ণধার নীরা রাদিয়া সাথে এ রাজা, কানিমোঝি, রতন টাটা, মুকেশ আম্বানি, কালানিথি মারান, সাংবাদিক বরখা দত্ত, সাংবাদিক ভির সাঙ্ঘভি ইত্যাদি বহু ‘হাই-প্রোফাইল’ ব্যক্তিত্বের কথোপকথন।
যাবতীয় কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক মহল এবং কর্পোরেট গোষ্ঠীর মধ্যেকার আসল সম্পর্কগুলোর অনেকটাই খোলসা হয়ে যায়। সাংবাদিক বরখার সাথে একটি কথোপকথনে দেখা যাচ্ছে যে, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকে দয়ানিধিমারানের পূণ র্বহাল আটকাতে কংগ্রেস ও ডিএমকে-তে নিজের প্রভাবকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছিলেন। আরও উল্লেখযোগ্য হল, রতন টাটার সাথে নীরার কথোপকথনে সরাসরি উঠে এসেছে, টেলিকম মন্ত্রী এ.রাজা-র সাথে নীরার সুসম্পর্কের কথা, যেখানে গোটা আলোচনাটাই হয়, টুজি স্পেকট্রাম বন্টন ও তাকে কেন্দ্র করে টাটা গোষ্ঠী ও আম্বানী গোষ্ঠীর মধ্যেকার দ্বৈরথ নিয়ে, স্পেকট্রামের লাইসেন্স আদায়ের প্রশ্নে যাবতীয় প্রভাব খাটানোর দীর্ঘ আশ্বাস দেন নীরা। ২০১০ সালে ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’ নীরাকে জেরা করলেও, ধীরে ধীরে তাঁর বিষয়টাই চাপা পড়ে যায়!
সরকারী আমলাদের মধ্যে টেলিকম সেক্রেটারী সিদ্ধার্থ বেহুড়া এবং এ.রাজার প্রাক্তন আপ্ত-সহায়ক আর.কে চান্দোলিয়ার নাম উল্লেখযোগ্য, যাঁরা রাজা এবং অন্যান্য কয়েকজনের সাথে সন্মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করেন আগে থাকতে সেটিং হয়নি এমন সব টেলিকম কোম্পানীগুলিকে লাইসেন্স পেতে আটকানোর জন্য।
মুনাফাখোর কর্পোরেটদের মধ্যে ইউনিটেক ওয়্যারলেসের এম.ডি সঞ্জয় চন্দ্র, রিলায়েন্সের অনিল ধিরুভাই আম্বানি গ্রুপের এম.ডি গৌতম দোষি, ভাইস প্রেসিডেন্ট হরি নায়ার ও সুরেন্দ্র পিপারা, ডিবি রিয়েলটি এবং সোয়ান টেলিকমের এম.ডি বিনোদ গোয়েঙ্কা প্রভৃতি মহা-তারকারা গ্রেফতার হন এই একই ষড়যন্ত্রে সামিল থেকে সরকারী আমলা, মন্ত্রী এবং পাবলিক সার্ভেন্টদের বিশ্বাসভঙ্গ করতে প্রলুব্ধ করা এবং প্রতারনা, জালিয়াতি ও প্রমান লোপাটের মত ঘৃণ্য অপরাধে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, গ্রেফতার হওয়ার পরেও চরম প্রভাবশালী নেতা-আমলা আর কর্পোরেটদের এই চক্রের প্রায় সব সদস্যই বিভিন্ন সময়ে জামিন পেয়ে এসেছেন, দেশের রাজনৈতিক ও প্রাশাসনিক পরিসরে তাঁদের ব্যপক ও বিস্তৃত প্রভাব আছে যা তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে, সেটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা হওয়ার পরেও!
২০১৩ সালের এপ্রিলে লিখিতভাবে রাজা স্বীকার করেন যে, ২০০৭-এর নভেম্বর থেকে ২০০৮-এর জুলাই-এর মধ্যে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং অর্থমন্ত্রী পি. চিদম্বরপমের সাথে দেখা করে টুজি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য দিয়েছিলেন, যদিওবা চিদম্বরম ও মনমোহনের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের চার্জশিটই গৃহীত হয়নি !!!
এরপর গোটা ঘটনাটা গত চার বছর ধরে সম্পূর্ণ নিরুচ্চারিত থেকে গত ২১শে ডিসেম্বর সিবিআই-এর বিশেষ আদালত ও.পি সাইনির বেঞ্চ এই কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত সমস্ত রাজনৈতিক ও কর্পোরেট ব্যক্তিত্বদের বেকসুর খালাস করে দেয়। দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দাবিদার দেশের, অন্যত্তম বৃহত্তম স্ক্যামে, বৃহৎ জঠরের রাজনৈতিক ও কর্পোরেট রাঘব-বোয়ালদের সন্মিলিত এই ভয়ানক ষড়যন্ত্রমূলক অপরাধ এভাবেই ধামাচাপা দেওয়া হয়, প্রমানের অভাব আর নিরপেক্ষ বিচারের ধুয়ো তুলে!
এরপর স্রেফ চক্ষুলজ্জাটুকুও যদি থেকে থাকে তবে, রাষ্ট্রব্যবস্থা, আইন, আদালত, সংবিধান ইত্যাদির শ্রেণী-নিরপেক্ষতার ‘মহান’ বুলি আর আওড়ানো যায় কি?
।। ২।।
দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে, ‘গণতান্ত্রিক’ আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে, ‘দুর্নীতি’-কে কালিমামুক্ত করার সাম্প্রতিক এই বৃহত্তম প্রচেষ্টাটি কার্যত প্রমান করে দিল, বুর্জোয়া রাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্র তুমি কার ¾ কোন শ্রেণীর?’ প্রাকৃতিক সম্পদের বরাত লুঠ করল রতন টাটা, মুকেশ আম্বানি-র মতো যে চোরেরা, সেই সকল ‘মহান’ পুজিপতিরা রয়ে গেল গোটা বিচার প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বাইরে। তার ওপর সাম্প্রতিক আদালতের রায়ে কানিমোঝি সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের ছাড়া পাওয়ার ঘটনাটি স্বাভাবিকভাবেই ইউপিএ জমানার এই ঘৃন্যতম ঘোটালাকে চেপে তো দিলই, এমনকি দেশের রাজনীতিতে কংগ্রেসকে কিছুটা ক্লিনচিট দেওয়া মারফৎ আবারও দ্বিদলীয় বুর্জোয়া রাজনীতির ও তাকে কেন্দ্র করে আগামি লোকসভা নির্বাচন অব্দি ‘বিজেপি-বিরোধী মহাজোট’-এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের স্থান পাকা করার দিকে নয়া উপাদান হিসেবেও কাজ করল; আর সেটাও গুজরাট নির্বাচনের ফল বেরনোর দুই দিনের মাথায়। ‘বিজেপি নাকি কংগ্রেস’, ¾ এই দুই জনবিরোধী কর্পোরেট-ভৃত্যদের কোনও একটির দিকে জনগনকে ঠেলে দেওয়ার এই ঘৃণ্য খেলার চক্রান্তের একটি উপাদান হিসেবেই ঠিক কিভাবে আজকের ভারতে এই ব্যপক দুর্নীতি এবং তার থেকে নিস্তারের নয়া-নয়া পথ উদ্ভুত হচ্ছে, অবশ্যই আম-জনতাকে বুড় আঙ্গুল দেখিয়ে, তাদেরকে আরও পাঁচটা করে বছর দুইয়ে নেওয়ার জন্য, তা গোপন রাখা আজ কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
ভারতবর্ষে নব্বইয়ের দশক থেকে নয়াউদারবাদের আনুষ্ঠানিক প্রবর্তন (দেশের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর হাত ধরেই, পরবর্তীতে যিনি আবার টুজি স্ক্যামের সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী) এদশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যপক পরিবর্তন সংগঠিত করে। দেশের দুর্নীতির সংখ্যা বেড়েছে কার্যত এক্সপোনেনশিয়ালি, নয়াউদারবাদের সাথে তাল রেখে। আমাদের দেশের এ যুগের দুর্নীতি বলতে যা বোঝায়, তারপ্রধান তিনটে ট্রেণ্ড রয়েছে : প্রথমত, অর্থলগ্নী সংস্থা বা চিটফাণ্ড জনিত দুর্নীতি; দ্বিতীয়ত, সরকারী তহবিল তছরূপ জনিত দুর্নীতি এবং তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক সম্পদ-জনিত দুর্নীতি। টুজি কেলেঙ্কারি পড়ছে এই তৃতীয় ধরনের দুর্নীতিতে এবং, এই তিন নম্বর দুর্নীতিটিই কেবলমাত্র অর্থের বিচারেই সবচাইতে বেশী পরিমানের নয়, এমনকি অর্থনীতির দিক থেকেও নয়াউদারবাদের যুগে ফিনান্স পুঁজির আরও সঞ্চয়নের কর্তৃত্বকামী একটি পন্থা।
এক্ষেত্রে যেটা আপাতভাবে দেখা যাচ্ছে যে, জনগনের ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকারবলে নির্বাচিত ‘সরকার’, নিলাম না করেই প্রাকৃতিক সম্পদের লিজ তুলে দিচ্ছে বড়ো বড়ো কর্পোরেটদের হাতে, তার প্রকৃত দামের চাইতে অনেক কম দামে! মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের একটা বড়ো অংশই এটিকে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু এটি বিষয়টির অতি-সরলীকরণ। এটা স্পষ্ট করে বোঝা প্রয়োজন যে, আদিম সঞ্চয়ন হল, এক দিকে পুঁজিপতি মালিকের হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপায়-উপকরনের গোটাটার সঞ্চয়ন, আর অন্যদিকে উৎপাদনের সমস্ত উপায় থেকে এক বিশাল অংশের জনগণের উচ্ছেদ, যাতে তারা বাধ্য হয় পুঁজিপতির কাছে তাদের শ্রমশক্তি বেচতে। এটা হল প্রাক্-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বশর্ত; আর সেজন্যই তাকে ‘আদিম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু পুজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যেও প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে পুঁজির সঞ্চয়ন ঘটে; মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির সম্পদ বাড়ে বিশাল অংশের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার শর্তে; তা পুঁজিবাদী সঞ্চয়ন, মোটেই ‘আদিম সঞ্চয়ন’ নয়।
এখানে তাই সবার আগে লক্ষ করা প্রয়োজন যে, স্পেকট্রাম-এর মতো প্রাকৃতিক উৎস জনগনের দখলে কোনোদিন ছিলই না, তা থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হয়নি; বরং তা ছিল বর্তমান বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দখলে, এবং রাষ্ট্রই কিছু বড়ো কর্পোরেটকে এগুলোর বরাত দেয়। তাই এই ধরণের দুর্নীতি, ‘আদিম সঞ্চয়ন’-এর মত পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্টির পূর্বশর্ত পালন করেনি, বরং এগুলোর মাধ্যমে অনেক অনেক পুঁজিপতিকে শোষনের ‘বুর্জোয়া অধিকার’ থেকে বঞ্চিত করে, শোষনের একচেটিয়াকরণের পথ প্রশস্ত করেছে। এমন কি আজকের ফাটকা অর্থনীতির যুগে উৎপাদন না করেও মুনাফা কামানোর রাস্তা করে দিয়েছে। নয়াউদারবাদী অর্থনীতির একটি অন্যতম উপাদান হল ডেরিভেটিভ ট্রেডিং, যার মূল কথাই হল, এখোনো অব্দি উৎপন্ন হয়নি এমন পণ্যের দামকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যত-চুক্তির ভিত্তিতে ফাটকাবাজি। খনি, গ্যাস বেসিন, স্পেকট্রাম, জমি ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎসগুলিকে এই সমস্ত কর্পোরেটরা তাদের ‘অ্যাসেট’ হিসেবে দেখিয়ে, শেয়ার মার্কেটে কয়েক লক্ষ-কোটি টাকার মুনাফা কামিয়ে নেয়। তার পর এমনকি উৎপাদন না করেই সে অ্যাসেট বেচেও দিতে পারে (টুজি-র ক্ষেত্রে আমরা আগেই সোয়ান টেলিকম, ইউনিটেক এবং টাটা টেলিসার্ভিসেস-এর উদাহরণ দেখিয়েছি)।
।। ৩।।
গোটা আলোচনা থেকে এটা সহজেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বাস্তবে বুর্জোয়া রাষ্ট্রের আনুকুল্যেই ঠিক কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানাকে কেন্দ্র করে কর্পোরেটদের মুনাফা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলে, যাতে অন্যতম ভূমিকা নেয় বুর্জোয়া পার্টিসমূহ ও তাদের প্রধান নেতা-মন্ত্রীরা। টু-জি দুর্নীতিও আসলে তেমনই একটা বিষয়। ডিএমকে নেতা এ রাজা, সাংসদ কানিমোঝি, ইউপিএ সরকারে থাকা তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্ব (ড. মনমোহন সিং ও সোনিয়া গান্ধী-কে বাদ দিয়ে যা ভাবা অন্যায়) ¾ এদের সকলেরই স্পষ্ট মদতেই যে, ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার এই দুর্নীতি ঘটানো সম্ভব হয়, তা কার্যত একটি দুধের শিশুও বোঝে!
আসলে এই গোটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে, প্রথমত, প্রকাশ পাচ্ছে দেশের তামাম পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা দেশের অগণিত শ্রমিক-কৃষক-মেহনতী জনতাকে শুষে খাওয়ার জন্য তাদের নিজেদের মধ্যে বর্বর খেয়োখেয়ি মাত্র, আর তার সাথে প্রকাশ পাচ্ছে ‘গণতন্ত্র’-এ ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’-দের পেশাদার বুর্জোয়া দালালিবৃত্তি।
দ্বিতীয়ত, টুজি কেলেঙ্কারির এই বর্বরদের আচমকা ছাড়া পাওয়ার মধ্যে কংগ্রেস তথা ইউপিএ জোটের সৈনিকদের প্রতি বুর্জোয়াদের নয়া আস্থার সূত্রপাতী রাজনীতি লুকিয়ে আছে নিঃসন্দেহে। প্রহসনের এই বিচারব্যবস্থা সকলের চোখ খুলে দিল, গুজরাত নির্বাচনে কিঞ্চিৎ ভালো ফলের মুখ দেখার মাত্র দুদিনের মাথায় কংগ্রেসকে এতবড়ো কালিমা ঘোচানোর সুযোগ দিয়ে, যা কার্যত জাতীয় স্তরে তাদের চুপসে যাওয়া ইমেজকে এক কাঠি উপরে তুলছে, আসন্ন ভবিষ্যতে লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দরকষাকষির জন্য।
তৃতীয়ত, এই গোটা ঘটনা বিজেপি’র মত বর্বর ও ঘৃণ্য উগ্র-কর্তৃত্ববাদী সরকারকে তাদের ‘গণতান্ত্রিক পরিচালনা’-র বিজ্ঞাপন দেওয়ার সুযোগ করে দিল যেন তাদের জমানাতেও বিরোধীরা সিবিআই-এর বিশেষ আদালতে ক্লিনচিট পেতে পারে, যখন দেশ জুড়ে তাদেরই নেতৃত্বে নোটবন্দী থেকে জিএসটির মত জনবিরোধী নীতির প্রণয়ন গরীব মানুষকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শুষে তো খাচ্ছেই, উপরন্তু ‘রাম-হনুমান-গোমাতা’-র নামে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে খুন করতে বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও টেনশনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারাই।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আখেরে জনগণের কাছে আজ নগ্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে গেছে আসল সত্যটা : এগুলো ‘দুর্নীতি’ নয়, এগুলই ‘রাষ্ট্রের নীতি’ ! যে মহান নয়া-মার্কসবাদীরা বুর্জোয়াদের চশমা প’রে ‘নিরপেক্ষ বিচার-ব্যবস্থা’-য় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ্ম্’ তথা ‘ধান্দার ধনতন্ত্র’-এর বিচার চাইতে সুর জুড়েছিলেন, তাঁদের গালে চড় মেরে ব্যবস্থা তার রায় জানিয়ে দিয়েছে : ক্যাপিটালিজ্ম্ ক্রোনি-ই হয় ! ধনতন্ত্র মানেই ধান্দা। মার্কস যথার্থই বলেছিলেন : “বেনিয়মই পুঁজিবাদের নিয়ম”!
অরিত্র বসু ‘পিপ্ল্স্ ব্রিগেড’ সংগঠনের সদস্য।
Image Courtesy: Indian Express
A very insightful article…