ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রটি খুবই জটিল এবং দুরূহ। বিগত ১৫০ বছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন পেশাদার অ-পেশাদার ইতিহাসবিদদের দ্বারা এই ক্ষেত্রটি একটি ক্রমাগত জটিল গুরুগম্ভীর এবং যুগপৎভাবে অসম্ভব সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠলেও আমরা দেখেছি তা ক্রমাগত একধরনের “অনৈতিহাসিক” চরিত্র লাভ করছে; এবং আগামী দিনেও করবে যদি না অশুভ উদ্দেশ্য সরিয়ে রেখে ইতিহাসের প্রতি বিষয়নিষ্ঠতার সাথে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এর চর্চা করা হয়। বিশেষ করে বিগত ৭০ বছর ধরে বামপন্থী অ প্রগতিশীল ইতিহাসবিদদের কাছে লড়াইয়ের ক্ষেত্রটি এই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ একদল মৌলবাদী (সবরকমের) ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসের নামে মিথ্যাচার করে চলেছে। সেজন্যই তাত্ত্বিকভাবে নতুন কোনো দিশা দেখানোর বদলে লড়াইয়ের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠছে (বিশেষতঃ গত ৩-৪ বছর ধরে বেশী করে) ইতিহাসের বিকৃতিসাধনের বিরুদ্ধে লড়াই।

এক

এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে আসে যে বিষয়টির কথা তা হলো ‘আর্য সমস্যা’। আসলে যে সমস্যাটির মূল লুকিয়ে আছে ভাষাতত্ত্বে। ১৬৫৩ সালে ডাচ পন্ডিত বক্সর্ন (Marcus Zuerius van Boxhorn) প্রথম ‘প্রত্ন ভাষা’ বিষয়টির অবতারণা করেন, যদিও ভারতে আসা বিদেশী পর্যটকদের অনেকেই ভারতীয় ভাষার সাথে ইউরোপীয় ভাষার মিল নজর করেছিলেন। এরপর ভারতে থাকাকালীন ফরাসি পন্ডিত কোর্ডক্স (Gaston-Laurent Coeurdoux) সংস্কৃত ও ইউরোপীয় ভাষার মধ্যে মিল দেখান; এবং ১৭৮৬ সালে উইলিয়াম জোন্স এশিয়াটিক সোসাইটির তৃতীয় বর্ষের সভায় এই বিষয়টি প্রমান করেন, যা পরবর্তী কালে ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ ভাষাতত্ত্বের জন্ম দেয়। এর পর অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ভূমিকায় এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পরবর্তী কালে এ নিয়ে আরো অনেক গবেষণা হয়েছে। সমস্যা হলো, এই গোটা বিতর্কের আর একটি দিক হলো আর্যদের মূল-বাসভূমি কোথায় ছিল। যার উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইতিহাসবিদদের একটি বড় অংশ ওই স্থানকে উরাল পর্বত, এশিয়া মাইনর, কিরঘিজদের তৃণভূমি প্রভৃতি এলাকাকে চিহ্নিত করেছেন। অনেকে মধ্য এশিয়াকেও করেছেন। শুধু কিছু ব্যক্তি ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশকে দেখিয়েছেন। ঊনবিংশ শতকে একটি বড় পর্ব ধরে এটি শুধুই অ্যাকাডেমিক বিতর্ক ছিল বলে মনে হয়; কিন্তু পরবর্তীকালে এটি সম্পূর্ণরূপে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। একদিকে বেদ ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্য পুনরায় চর্চার মতো এই বিষয়ের অবতারণা ঘটেছিল এমন এক সময়ে যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তার উপনিবেশ ভারতকে নিষ্পেষিত করছে। ফলে ‘প্রাচীন গৌরব’-এর ভ্রান্ত ধারণা ও ‘শাসিত-ভারতীয়’ এবং ‘শাসক-ইংরেজ’ আসলে একই জাতি এই মেকি গর্ববোধ সামগ্রিক বিষয়টিকে অ্যাকাডেমিক চর্চার পাশাপাশি ভুল পথেও চালিত করে শুরু থেকেই। তারপর বিশ্বজোড়া ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদের সূত্রপাত এবং হিটলারের ‘আর্য জাতি’ তত্ত্ব যা ভারতে এক ব্রাহ্ম্যণ্যবাদী রাজনীতির অনুপ্রেরণায় সহায়তা করে।
স্বভাবতই পরবর্তীকালে আমরা দেখতে পেলাম ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষীদের ভারতবর্ষের মানুষ হিসেবে তুলে দেখানো হলো, বৈদিক সভ্যতাকে ভারতের সংস্কৃতির মূল হিসেবে দেখানো হলো তা যতই অধিকাংশ ভারতবাসীর গায়ের রং, চোখের রং, চুলের রং, নাকের উচ্চতা প্রভৃতি নিয়ে তথাকথিক ‘নর্ডিক রেস্’ বা ‘ইন্দো-ইউওরপীয়’ ভাষার লোকেদের পার্থ্যক্য থাকুক, এবং যতই মানুষ এটা বুঝতে পারুক যে ভাষা কোনো বিশেষ রেস্ বা ধর্ম-এর সম্পত্তি নয়; এবং শধু ওই তথাকথিত ‘নর্ডিক’-রাই নয় বরং ‘মেডিটেরিনিয়ান’ ও ‘ব্রাকিসিফেলিক’-দের একাংশ ওই ভাষায় কথা বলতো। এবং যতই আবেস্তার গাথা এবং বর্ণিত কিছু ব্যক্তির বৈদিক ব্যক্তির সাথে মিল থাকুক না কেন, বা যতই এই ভাষাগোষ্ঠীর জীবিত ও মৃত ১৯টি শাখার মাত্র তিনখানা এশিয়ায় পাওয়া যাক না কেন, এই ইতিহাসবিদরা দেখবেন যে ‘আর্য’-রা ভারতের, কারণ ‘রামায়ণ’-‘মহাভারত’ ভারতে লেখা হয়েছে, বেদ ভারতে লেখা হয়েছে। তারপর আর্যদের কিছু অংশ বিদেশে গেছে। তাহলে দক্ষিণ ভারতে এতো পরে আর্য সংস্কৃতি গেলো কেন? জবাব নেই। এই সব ইতিহাসবিদেরা দেখাবেন যে সরস্বতী নদী ভারতে ছিল। অথচ একবারের জন্যও দেখানো হবে না আবেস্তার ‘হর্বক্ষয়তি’ (আজকের আফগানিস্তানের ‘হেলমান্দ’) কোথায় ছিল। আসলে ওই নদীর নামে যে একাধিকবার ভারতীয় নদীগুলি নামাঙ্কিত হয়েছে তা নিয়ে তাঁদেরও কোনও সন্দেহ নেই।
কোনোদিনও আলোচনা করা হয় না গ্রিক, রোমান, পারসী দেবতাদের সাথে বৈদিক দেবতাদের নাম, কাজের এতো মিল কেন, এমন কি নিয়ম-কানুনেও এতো মিল কেন? কীভাবে আবেস্তাতেও গায়ত্রী ছন্দ দেখা যায়? ইত্যাদি।

দুই

ভারতে ইতিহাসের বিকৃতির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘হরপ্পা সভ্যতা’-কে আর্যদের সভ্যতা বলে দেখানো এবং তাদের লিপিকে ব্রাহ্মী লিপি এবং ভাষাকে ‘সংস্কৃত’ ভাষা হিসেবে দেখানোর অপপ্রয়াস।
মূলতঃ কয়েকটি ধারায় এই আক্রমণটি শানানো হয়। প্রথমতঃ দেখানোর চেষ্টা করা হয় যে আর্যরা আক্রমন করেনি, তারাই এই হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। কারণ হরপ্পায় যে ত্রিমুখ যোগী-র একটি শীলে অংকিত মূর্তি পাওয়া গেছে তা অনেকটা মহাদেব বা শিবের মতো দেখতে। বহু ইতিহাসবিদ একে আদি-শিব বা প্রত্ন-শিব বলে দাবি করেছেন; সম্প্রতি এ ব্যাপারে কিছু উপন্যাস ও রচিত হয়েছে যাকে ইতিহাস বলে চালানোর চেস্ট হচ্ছে। এক কালে বাংলায় এভাবেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটককে ইতিহাস বলে চালানো হত। এছাড়া দেখানো হয় যে হরপ্পায় নাকি কুঠার পাওয়া পাওয়া গেছে (যার সাথে পরশুরাম-এর কুঠার-এর মিল খুঁজে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে)। যদিও বহুকাল আগেই মার্ক্সবাদী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ভারতে পথিকৃৎ ডি ডি কোশাম্বি একে ‘মধ্যপ্রদেশ’ অঞ্চলে প্রচলিত আদিবাসীদের দেবতা ‘মাদোভা’-এর সাথে অভিন্ন বলে প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়তঃ দেখানো হচ্ছে যে এই সভ্যতার নামই হলো ‘সিন্ধু-স্বরস্বতী’ সভ্যতা; যেহেতু বেদ-এ সিন্ধুর সাথে সরস্বতী নদীর নাম আছে, এবং এই অঞ্চলে এক কালে সত্যি একটি নদী ছিল যার নাম স্বরস্বতী যা বর্তমান কালে লুপ্ত, যদিও বহু ইতিহাসবিদ মনে করেন (যেমনটি আগেই বলেছি) বেদের সরস্বতী আসলে হর্বক্ষয়তি, যার নাম পরে ভারতের একাধিক স্থানে সরস্বতী হয়েছে।
তৃতীয়তঃ দেখানো হয় যে একটি শীলে ঘোড়ার ছবি আছে, যেহেতু ইতিহাসবিদেরা দাবি করতেন যে হরপ্পা সভ্যতাতে ঘোড়ার ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ওই শীলে যে ছবি আছে তা অধিকাংশ ইতিহাসবিদেরা কল্পিত প্রাণী ‘ইউনিকর্ন’ বলে দাবি করেছেন যার কল্পনা বহু প্রাচীন সভ্যতাতেই করা হয়েছে।
চতুর্থত: ব্রাহ্মীলিপির পূর্বসূরি হিসেবে হরপ্পা লিপি-কে দাবি করা হয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন: ১) ব্রাহ্মী লিপি রেখা লিপি, পুরোদস্তুর, আরবি-পার্শি বা রোমান লিপির মতো, তাতে সামান্য আকারেও চিত্রলিপির ছোঁয়া পাওয়া যায় না…. কারণ আরবি বা পার্শি তে আলেফ মানে আ বা অ, রোমান লিপিতে আল্ফ়া মানে A; কিন্তু ব্রাহ্মী থেকে জন্মানো লিপিগুলোতে ‘অ’ এর কোনো নাম নেই।
২) এটা অসম্ভব যে অশোকের আগে কোনো রকমের লিপি ছিল না।
৩) ব্রাহ্মী বাম দিক থেকে লেখা শুরু হয়। হরপা শুরু হয় ডান দিক থেকে, পুরোদস্তুর চিত্রলিপি; এবং এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে যারা যারা ওই লিপির পাঠোদ্ধার করেছেন বলে দাবি করেন তারা তারা কোনো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে পারেনি। অথচ একটি মহল থেকে নিয়মিত দাবি করা হচ্ছে যে হরপ্পা লিপি ব্রাহ্মীর পূর্বসূরি, তার ভাষা সংস্কৃত।
এর সাথে সাথে আর একটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিকৃতিসাধন হলো সংস্কৃত ভাষা নিজেই। পানিনি এই ভাষাটির কাঠামো তৈরী করেন কারণ ‘বৈদিক ভাষা’ (যা ব্যাকরণগত দিক থেকে সংস্কৃত থেকে সামান্য আলাদা, কারণ এতে এমন কিছু স্বরধ্বনির ব্যবহার আছে যা সংস্কৃত ভাষায় ব্যবহার হয় না) নাকি সাধারণ মানুষের হাতে পড়ে নষ্ট হচ্ছিলো। এই ভাবে সংস্কৃত জন্ম থেকেই একটি কৃত্রিম ভাষা এবং আজ অবধি কোনো ভাষার জন্ম দেয় নি; ভারতীয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার জন্ম পুরোপুরি বৈদিক ভাষার উত্তরসূরি হিসেবে মানুষের মুখে টিকে থাকা প্রকৃত ভাষা ও তার বিভিন্ন আঞ্চলিক ঝোঁকগুলো থেকে। অথচ ক্রমাগত সংস্কৃত ভাষাকে সব ভারতীয় ভাষার জননী বলে দেখানো আসলে মনুবাদী, ব্রাহ্মণ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়।
এর সাথে সাথে চলে আসে রামায়ন-মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণগুলি থেকে একপ্রকার ঘৃণ্য ঐতিহাসিক বিকৃতির বিষয়, যে বিকৃতি নিয়েই আলাদা করে গবেষণা হয়ে দরকার।

তিন

রামায়ণ ও মহাভারত নিয়ে বিকৃতির ইতিহাস সুপ্রাচীন। কারণ, প্রথমত এই দুই মহাকাব্য সাহিত্যের গন্ডি ছাড়িয়ে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে, দ্বিতীয়ত দুই মহাকাব্যের নায়ককে ভারতীয় হিন্দু দেবতা ‘বিষ্ণু’-র অবতার বলে চিহ্নিত করা হয়, যার ফল হলো এই যে ভারতের এক বিপুল অংশের মানুষ যাদের কাছে শাসক শ্রেণীর ভ্রান্ত শিক্ষা নীতির ফলে আজ শিক্ষার আলো পৌঁছয়নি, তারা এবং, প্রজন্মের পর প্রজন্ম কুসংস্কার ও ধর্মীয় আবিলতায় নিমজ্জমান ব্যক্তি এদের বাস্তব বলে ধরে এসেছে। যার ফলে এখানে লড়াই অনেক তীব্র।
আজ সব থেকে বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে রাম-এর জন্মভূমি। খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতকের যা উপাদান এখানে পাওয়া গেছে তাতে অঞ্চলটি মোটেই কোনো নগর ছিল না, যেমনটা রামায়ণে বলা হয়েছে, বরং একটি প্রিমিটিভ অঞ্চল ছিল। এবং রামায়ণে বর্ণিত যে সমাজ তা ওই সময়ের আগে। প্রাচীন কোশল-এর রাজধানী হিসেবে যে নগর গুলোর নাম পাওয়া যায় তা হলো শ্রাবস্তী এবং সাকেত। এবং এই সাকেত হলো সম্ভবতঃ আজকের অযোধ্যা। এবং এই নামটি নির্ঘাত গুপ্তরাজ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দ্বারা উচ্ছেদ হয় সকদের হারানোর পরে। বৌদ্ধ এবং জৈন গ্রন্থগুলোতে এই নাম নেই। সেখানে সাকেত আর শ্রাবস্তী আছে যেখানকার রাজা ছিলেন প্রসেনজিৎ (কোশলরাজ)।
এনিয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে রামানন্দীদের উত্থানের পর থেকেই অযোধ্যাকে রাম-এর সাথে যুক্ত করা হয়, কারণ পুরাণে কোশলরাজ্যের অধিপতি পরিবারকে ইক্কাক্ষু বংশ হিসেবে দেখিয়েছে কিন্তু সেখানেও সরযূ নদীর তীরের অযোধ্যার বদলে গঙ্গার উল্লেখ আছে; এদিকে সরযূ নদীর নাম যেভাবে পাওয়া গেছে এবং আবেস্তাতেও যেভাবে এই নদীর কাছাকাছি নাম পাওয়া গেছে তাতে এই নদীটিকে এবং গোমতীকে মধ্য এশিয়ার নদী বলেই মনে হয়; সম্ভবত সরস্বতীর মতো এরও একই রকম ভাবে নামকরণ হয় (অক্ষয়কুমার দত্ত-এর ‘উপাসক সম্প্রদায়’ দেখুন)।
এদিকে কালিদাসও রঘুবংশ যে ভাবে লিখেছেন তাতে রামের প্রপিতামহ ‘রঘু’-র সাথে ‘সমুদ্রগুপ্ত’-র খুব মিল। এবং ‘অজ’ (রামের ঠাকুরদা)-র স্থানে চন্দ্রগুপ্তের প্রভাব থাকা অসম্ভব নয়।
সব মিলিয়ে কিন্তু রামায়ণের অযোধ্যাকে কাল্পনিক শহর বলেই মনে হয়। ইতিহাসবিদ না হলেও রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর রচনায় অন্য আভাসই দিয়েছেন (‘জয় যৌধেয়’ এবং ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’)।
কিন্তু জোসেফ তিয়েনফেন্থালের সেই ১৭৮৮ সালেই (আসলে ১৭৬৬-১৭৭১ লেখক ওই অঞ্চল ঘোরেন এবং লেখেন যা ১৭৮৮ সালে জন বার্নৌলি ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন) দাবি তোলেন যে বাবর বা ঔরঙ্গজেব কেউ একজন অযোধ্যাতে একটি মন্দির ভেঙে মসজিদ করেন, যা কিনা রামের মন্দির ছিল। এবং স্থানীয় হিন্দুরা ওই অঞ্চলে মাটির মূর্তি বানিয়ে সেই জায়গায় পূজা করতো যা নাকি তারা মনে করতো রামের জন্ম ঘর হিসেবে। এর পর ১৮১০ সালে ফ্রান্সিস বুখানোনও একই দাবি করেন, শুধু তাঁর মতে রামের ঘর নয় ওটা রামের মন্দির ছিল।
কিন্তু রামশরন শর্মা দাবি করেন যে ১৮ শতকের আগে অযোধ্যা হিন্দুদের তীর্থস্থান ছিলই না। এমনকি তুলসীদাসও তাঁর ‘রামচরিতমানসে’ এরকম কোনো দাবি করেন নি।
১৮৫৩ সালে, নির্মোহ আখড়ার সাথে জড়িত সশস্ত্র হিন্দু সন্ন্যাসীদের একটি দল বাবরি মসজিদ স্থান দখল করে এবং মসজিদের মালিকানা দাবি করে। পরবর্তীতে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ তাদের সরে যেতে বাধ্য করে, এবং ১৮৫৫ সালে, মসজিদ প্রাঙ্গন দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়, একটি হিন্দু এবং অন্যটি মুসলমানদের জন্য।
১৮৮৩ সালে হিন্দুরা একটি মন্দির নির্মাণের প্রচেষ্টার সূচনা করে। প্রশাসন যখন তাদের এটা করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে তখন, তারা আদালতে মামলা করে। ১৮৮৫ সালে হিন্দু সাব-জজ পণ্ডিত হরি কিশান সিং মামলা দায়ের করেন। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশের পক্ষে ১৮৮৬ সালে মামলা দায়ের করে। পরবর্তীকালে, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে কিছু হিন্দু, মসজিদে রাম ও সীতার মূর্তি স্থাপন করেন এবং দাবি করেন যে মূর্তিগুলি সেখানে অলৌকিকভাবে উপস্থিত হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু ভক্তরা এই স্থান পরিদর্শন করতে শুরু করে, সরকার মসজিদটি একটি বিতর্কিত অঞ্চল ঘোষণা করে এবং তার দরজাগুলি বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে, হিন্দুরা একাধিক মামলা দ্বারা, এই স্থান পূজা করার স্থান হিসাবে অনুমতি দেওয়ার অনুমতি চেয়ে। ১৯৮০ সাল থেকে ক্রমাগত উত্তেজনা ছড়াতে থাকে যা চরমে ওঠে দূরদর্শনে ‘রামায়ণ’ সিরিয়াল চালু হওয়ার পর। ১৯৯২ সালে হিন্দুত্ববাদীরা বর্বরোচিত ভাবে বাবরি মসজিদ, যা এক ঐতিহাসিক স্থাপত্য, ভেঙে দেয়।
মহাভারত নিয়েও নানা প্রকার বিতর্ক একই ভাবে আছে। তবে মজার ব্যাপার তা নিয়ে বাড়াবাড়ি কম হয় কারণ মহাভারত নিয়ে বিতর্ক করবার মতো জ্ঞান হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে কম আছে। তাছাড়া চূড়ান্ত রক্ষণশীল এই হিন্দ্বুত্ববাদীরা মহাভারতের বিভিন্ন সম্পর্কগুলো ব্যাখ্যা করলে ‘সমস্যা’-য় পড়তে পারে। অগত্যা …।
আক্রমণ শুধুমাত্র রামায়ণ মহাভারত নিয়েই তৈরী হয়নি, হয়েছে আরো কয়েকটি বিষয় নিয়ে। যেমন দিল্লিতে সুফী সাধক কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামে কুতুব মিনার বানানো শুরু করেন কুতুব-উদ্দিন-আইবেক, যা তাঁর জামাই ইলতামাস (যাকে অনেক সময় ভুল করে ইলতুৎমিশ বলা হয়) শেষ করেন। সম্প্রতি দাবি তোলা হয়েছে, ওটা নাকি গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বানানো। এবং ওটাই নাকি কুতুব উদ্দিন নিজের নামে চালিয়েছে। তাজ মহল নিয়ে পর্যন্ত সম্প্রতি যা শুরু হয়েছে তা সবাই দেখছে। এবং রাজপূতদের ‘কিংবদন্তি’ নিয়েও যা হচ্ছে তাও। মালিক মুহম্মদ জায়সী ‘পদুমাবৎ’ লেখার আগের প্রায় ২০০ বছরে কোনো নথিতে ‘পদ্মাবতী’ বলে কোনো মহিলার নাম না থাকলেও তাকে নিয়ে কিংবদন্তি আছে অনেক। তার ঐতিহাসিক যুক্তি না দেখে সিনেমা বানানোর ফলে যা চলছে তা ভাবাই যায় না। ভয় লাগে …এবার যদি কেউ প্রমান দেখায় যে গাড়োয়াল রাজ্যের কোনো ‘সংযুক্তা’ বলে মেয়ে ছিল না বা ‘ভাগমতী/হায়দরাবাদমহল’ বলে কুলি কুতুব শাহের কোনো রানী ছিলেন না, কৃষদের রায়ের সভায় ‘তেনালিরাম’ বলে কেউ ছিলো না বা ‘গোপাল ভাঁড়’-এর কোনো ঐতিহাসিক অস্তিত্বই নেই, তা হলে হয়তো চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হবে।
আসলে মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও পন্ডিতদের দানও বিশেষ কম নয়। জেমস টড বলে একজন রাজপুতানার গ্রামে গ্রামে ঘুরে যা লোকমুখে শুনলেন তাকে বিন্দুমাত্র যাচাই না করে বই (অ্যানালাস এন্টিকুইটিস অফ রাজস্থান) লিখলেন; আর অবনীন্দ্রনাথ থেকে রঙ্গলাল, বঙ্কিম থেকে দ্বিজেন্দ্র সবাই তার ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য রচনা করলেন। আজ তার ফল ভুগছি আমরা।
ভাষা নিয়েও বাঙ্গালীদের সমস্যা কম নয়। একেই তো হেমচন্দ্রের দেখানো ‘চার প্রকার’ প্রাকৃত শিখে সবাই পন্ডিত, তার ওপর আবার চূড়ান্ত ‘উচ্চ-আভিজাত্য-নাক সিটকানো’ যুক্তি এবং শব্দ হলো ‘অপভ্রংশ’ (কারোর ভাষাকে কেউ কি করে অপভ্রংশ বলতে পারে…. ! আসলে এসব তারাই মানে যারা ‘কলকাতার’ ভাষাকে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ আর গ্রামের মানুষের ভাষাকে ‘গেঁয়ো’ বলে নাক সিটকায়, এরা জানলেও মানতে চায় না যে উভয় ধাঁচ-ই আসলে উপভাষা); তার ওপর খড়িবোলি ভাষার একটি বিশেষ ধাঁচ যা আসলে দিল্লি-মিরাট অঞ্চলের মানুষের (ধর্ম-নির্বিশেষে) মুখের ভাষা, তাকে মুসলমানের ভাষা বলে অচ্ছুৎ করে দিয়ে মেরে ফেলেছে, এবং তার বদলে সংস্কৃত মেশানো খড়িবোলির একটি বিশেষ রূপকে ‘জাতীয় ভাষা’ বলে আগ্রাসী নীতি চালাচ্ছে।
এই অবস্থায় বামপন্থী ইতিহাসবিদদের যা করণীয় তা তারা কতটা করছেন বা করতে পারছেন তা বলা মুশকিল। কারণ মনে রাখতে হবে বহু বামপন্থী ‘পূর্বতন’-দের সংশোধন করার নামে বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বনের বদলে আসলে বামপন্থা থেকেই সরে যাচ্ছেন, যা কিছু দিন বাদে আদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে অবধারিত সংকট তৈরী করবে।
সাধু সাবধান !
Join for history as a historian.

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *