এদেশের রাজনীতির পটভূমিতে বর্তমান শাসক দল বিজেপি-র প্রধান পরিচয় হল প্রথমত, নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির নগ্ন প্রতিভূ রূপে এবং দ্বিতীয়ত, সাম্প্রদায়িক ঘৃণাবার্তা প্রচারের জন্য তার চূড়ান্ত রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদের প্রতীক হিসাবে, যার মধ্যে নিঃসন্দেহেই ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থানের বীজ লুকিয়ে আছে।
সারা দেশ জুড়ে আজ যখন উগ্র-হিন্দুত্ববাদীরা প্রবল পরাক্রমে গুজরাটের ‘রামরাজ্য’-এর মহিমা প্রচারে ব্যস্ত, তখন আজ থেকে ১৬ বছর আগে গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাসের মাথায় ঠিক কিভাবে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক গণহত্যায় নেতৃত্বদাতারা আজকে দেশ ও দশের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা বিধাতা বনে গেলেন তা দেখে নেওয়া দরকার। কারণ বিজেপি ও আর.এস.এস-এর নেতৃত্বে ভারতবর্ষে তৈরী করা সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলোর একটি যদি হয় ১৯৯২ সালের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত, তবে তাদের বর্বরতার চরম সীমার অপর উদাহরণ হল ২০০২ সালের ‘গোধরা গণহত্যা’।
ইতিহাসকে আমরা ফিরে দেখা শুরু করব প্রথমেই কতগুলো নাম মারফৎ; ১৬ বছরে নর্মদা দিয়ে বয়ে যাওয়া লক্ষ্য-কোটি স্রোতে অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে যাওয়া সেই নামগুলোই গুজরাট দাঙ্গার জীবন্ত জীবাশ্ম :
সুলতান: এরাল গ্রাম, জেলা পাঁচ মহল, ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০২-এর জেনোসাইডে গণধর্ষিতা।
বিলকিস বানু : রান্ধিকপুর গ্রাম, জেলা দাহোড়, ২রা মার্চ, ২০০২-এ গণধর্ষিতা।
কুসুম বিবি : নারোদা পাটিয়া, আমেদাবাদ, ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০২-এর জেনোসাইডে নিজের নাবালিকা মেয়ে সহ গণধর্ষিতা।
জন্নত শেখ : নারোদা পাটিয়া, আমেদাবাদ, ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০২-এর জেনোসাইডে গণধর্ষিতা এবং মৃত।
বলাই বাহুল্য এদের অপরাধীরা সাজা পায়নি। কারণ তারাই এখন ভারতের মসনদে।
২০০১ সালের অক্টোবর মাসে কেউ ঘুণাক্ষরেও কি টের পেয়েছিল যে জীবনে প্রথমবার ভোটে দাঁড়ানো একটা লোককে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করার কয়েক মাসের মধ্যে গুজরাটবাসীকে তার এমন মাসুল চোকাতে হবে? মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ২০০২ সালের ২৭ শে ফেব্রুয়ারি গোধরা কান্ডের পর এমন সব কীর্তি তিনি করে গেলেন যা তাঁকে শেষমেষ প্রধানমন্ত্রীর পদে এনে বসাল। সেদিনের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী এবং আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন গোটা দেশকেই গুজরাট বানিয়ে দেবেন বলছেন, তখন বুঝতেই হবে যে তিনি কোন ‘গুজরাট মডেল’-এর কথা বলছেন! তাই সেটা চোখ খুলে দেখে নেওয়া দরকার।
সালটা ২০০২। এপ্রিল মাসে গুজরাট সরকার বলল যে মোদীল্যান্ডে সব কিছুই নাকি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা ছিল, শাহ-এ-আলম, জুহাপুরা, চার তোরা কবরস্থান, গোমতিপুর, সুন্দরমনগর, কুতুব-এ-আলম, হালোল সহ একাধিক রিলিফ ক্যাম্পে লক্ষাধিক দাঙ্গাকবলিত মানুষ তখনও রয়ে গেছেন। কি হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখে?
দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল সকাল ঘোষণা হল যে “আজ গুজরাট বন্ধ্ র্যহেগা”। তারপর ওই দিনই বিকেল বিকেল লোকভর্তি গাড়ি পৌঁছল মহল্লায় মহল্লায়। গাড়ির সামনে সারি সারি পুলিশ, কাঁধে লাগানো গুজরাট পুলিশের ব্যাজ। গাড়িভর্তি লোকেদের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র, আর মুখে ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি। আচমকাই শুরু হল নর-সংহার। এর পরের ঘটনা সকলের জানা। হাজারে হাজারে মানুষকে চক্ষের নিমেষে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে দিল সঙ্ঘ পরিবারের পশুরা। ধর্ষণ করে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হল শত-সহস্র মেয়েদের। বাদ পড়েনি ভ্রূনস্থ শিশুও। অপরাধ (!) তাদের একটাই – তারা মুসলমান। এ ‘অপরাধ’-এর ক্ষমা নেই রামভক্ত বর্বর হিন্দুত্ববাদী হনুমানদের কাছে। এরপর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া : “এটা নিছকই একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নয়, এটা ছিল একটা গণ-আন্দোলন”! অর্থাৎ, রাখঢাক না রেখেই মোদি জানিয়ে দিলেন যে, তিনি আক্রমণকারীদের পাশেই ছিলেন, আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। সঙ্ঘ পরিবার দম্ভ ভরে জানালো : “জনগণ প্রতিশোধ চেয়েছিল এবং পেয়েছে”। কিসের প্রতিশোধ?
ঠিক আগের দিন, ২৭ শে ফেব্রুয়ারী বুধবার, সবরমতি এক্সপ্রেস (৯১৬৬ আপ) রাত ২ টো ৫৫-র পরিবর্তে সকাল ৭টা ৪৩-এ এসে পৌঁছায় গোধরা ষ্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ওইদিন সন্ধ্যেবেলায় গুজরাট সরকারের প্রেস রিলিজে ওই ট্রেনে বিস্ফোরণে ৫৯ জনের মৃত্যুর খবর জানা যায়। মুখ্যমন্ত্রী মোদি এ বিষয়ে প্রথম উস্কানি-মূলক মন্তব্য করেন যে, এটি একটি ‘অ্যাক্ট অফ টেররিজম’!
মৃতদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল করসেবক, যারা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভা থেকে ফিরছিল। সভার বিষয় ছিল অযোধ্যাতে রাম মন্দির নির্মাণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের অর্ডারের বিরোধিতা করা। অথচ গুজরাট পুলিশ সবরমতি এক্সপ্রেসের পোড়া কামরার (এস-৬) ফরেন্সিক টেস্ট করিয়েছিল পাক্কা দুই মাস পরে। আসলে সবরমতি এক্সপ্রেসের অগ্নিকাণ্ডের কোনো রকম তদন্ত ছাড়াই ‘সন্ত্রাসবাদী চক্রান্ত’ বলে দেওয়াটা ছিল একেবারেই পরিকল্পিত রাজনৈতিক ইন্ধন, হিন্দুত্ববাদীদের গণহত্যা চালানোর লাইসেন্স। ঘটনার দীর্ঘদিন বাদে পুলিশের সাজানো রিপোর্ট-এর মাধ্যমে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল কেবল বিরোধী এমপি-দের দিকে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজবপনকারী ওই অযোধ্যা ক্যাম্পেনের বিরোধিতা করছিলেন।
গোধরা কান্ডের পোস্টমর্টেম : ঘৃনার রাজনীতি গোধরায় সবরমতি এক্সপ্রেসের কামরা থেকে জন্ম নেয় নি
ফরেন্সিক এক্সপার্ট নীতিন কুমার বিশ্বাসের মতে “গুজরাটের গোধরার সবরমতী এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরার আগুন ধরার বহর আর মাত্রা দেখে এটা স্পষ্ট যে, পূর্ব দিকের চেয়ে পশ্চিম দিকটাই বেশী পুড়েছে। বাইরে থেকে কোনো তরল বা অ্যাসিড জাতীয় পদার্থ ছুঁড়ে ফেলা হয়নি। কারণ কামরার সব জানালা বন্ধ ছিল, কামরার ছাদ মাটি থেকে ৭ ফুট উঁচু অথচ ভেতরের পশ্চিম দিকে মাটি থেকে ছাদ যেভাবে পুড়েছে তাতে এটা স্পষ্ট। বাইরে থেকে কিছু ফেললে বাইরের দিকটাই বেশী পুড়ত। কিন্তু সেটা হয়নি।” ওই কামরায় কোনো বিস্ফোরক বা আগ্নেয়াস্ত্রের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। সবরমতি এক্সপ্রেস কে বা কারা জ্বালালো আর কেনই বা জ্বালালো সে প্রশ্নের উত্তরও খোঁজেনি সেদিন গুজরাট সরকার, কিন্তু গুজরাটের তামাম মুসলমানদের ‘সাজা’ ঘোষণা করে তা বলবৎ করে দিল পরের দিনই! অন্যদিকে ওই ট্রেনের গার্ড তার ঊর্ধ্বস্তন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল যে, এস-৬ কামরায় করসেবকরা দাহ্য পদার্থ নিয়ে যাচ্ছিল। আবার ফজিয়াবাদের জনমোর্চা ঘটনার তিন দিন আগে ২৪ শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করে যে, করসেবকেরা ট্রেনে যেতে যেতে মুসলমান যাত্রীদের লোহার রড দিয়ে পেটাবে এবং বলপুর্বক ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করতে বাধ্য করবে। ট্রেনের মধ্যেই তারা মুসলিম মহিলাদের শ্লীলতাহানি করবে। অথচ সঙ্ঘ পরিবারের নির্লজ্জ পশুবৎ নেতৃত্বের দাবী যে, গুজরাটের মুসলিমরা হিন্দুদের উপর সবরমতী এক্সপ্রেসে যে ‘আঘাত’ হানে, তার প্রতিশোধ নিতেই হিন্দুরা পরদিন ২৮শে ফেব্রুয়ারী মুসলিম সংহার করেছে !
প্ল্যান অফ অ্যাকশন- ২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০০২, গুজরাট :
সকাল সকাল কার্ফ্যু জারি হল সারা গুজরাটে। সকলেই ঘরে বন্দী। ছুটির দিনে ঘরে ঘরে পরিবারের সাথে খানাপিনার বন্দোবস্ত চলছিল। হঠাৎ বিকেল থেকে পাড়ার মোড়ে মোড়ে জমা হল গেরুয়া বাহিনী। প্ল্যান ফুলপ্রুফ করতে সঙ্গে ছিল পুলিশ বাহিনী। তাদের ওপর দায়িত্ব বর্তেছিল একজন মুসলিমও যেন বাদ না যায়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান অনুযায়ী “পুলিশের দল সকালে মাইক ফুঁকে বলে গেল যে কার্ফ্যু জারি, অথচ বিকেলে চেঁচামেচির মধ্যে দেখি সামনে পুলিশ গুলি চালাচ্ছে আর পেছনে পেছনে এগোচ্ছে বজরং দলের জমায়েত। আমি আর আমার সব ভাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পালাতে গেলাম আর আমার ভাইয়ের ছাতিতে সামনে থেকে পুলিশ গুলি করল। পুলিশ আমাদের মেরে তাড়াচ্ছিল আর ওদের সঙ্গে করে নিয়ে আসছিল। আমাদের মারতে আর আমাদের ঘর জ্বালিয়ে দেবার অর্ডার দিচ্ছিল”। এক লহমায় সরকার উধাও, সঙ্ঘ পরিবারই সেদিন সরকারের জায়গা নিয়ে চালাল গনহত্যা।
২৮শে ফেব্রুয়ারি সকালে পরিকল্পনামাফিক কার্ফ্যু জারি করে মানুষকে ঘরবন্দী করে, চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলে হাজার হাজার মানুষের ওপর হত্যালীলা চালানোর এই ঘটনাকে, সুপ্রিম কোর্ট শেষ পর্যন্ত ‘জেনোসাইড’ বলে সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য হয়েছে, অথচ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি এই গণহত্যার দায়ও স্বীকার করেননি, ক্ষমাও চাননি এবং আজ দেশের মসনদে।
জেনোসাইডের প্রথম ৩ দিন গোটা গুজরাটের সর্বত্র হয় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল নয়ত কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ আক্রমণকারীদের পক্ষে কাজ করেছে। হাইকোর্টে পুলিশ ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে এমন মামলাও করা হয়েছে যাতে দেখা গেছে যে, একজন ইনস্পেক্টরের সামনে বজরং দলের লোকেরা তান্ডব চালিয়ে, ওই ইনস্পেক্টরেরই গাড়ি থেকে তেল নিয়ে মুসলিমদের গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারে। একাজে ওই পুলিশ ইন্সপেক্টর সাহায্য করেন। এক ভুক্তভোগী মহঃ আনসারি জানান যে, সঙ্ঘ পরিবারের লোকেরা তার পরিবারের লোকেদের পুড়িয়ে মারার আগে হাতে কাগজ নিয়ে বলেছিল যে গোধরার কান্ডের বদলা নিতেই ওদের মারা হবে। গুজরাট ছেড়ে চলে যেতে হবে নয়ত’ বাধা দিলে মরতে হবে। গোধরার কাণ্ড ঘটানোর অপরাধের শাস্তি দিতে সরকার থেকে ওদের মারার হুকুম দেওয়া হয়েছে।
২৮ তারিখ সারাদিন গোটা গুজরাট দাউ দাউ করে পুড়লো, কিন্তু কোথাও ফায়ার ব্রিগেডের দেখা পাওয়া গেল না। সেন্ট জেভিয়ার্স স্যোশ্যাল সার্ভিস সোসাইটির ডিরেক্টর ভিক্টর মোসেস এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, “আমেদাবাদে সর্বত্র আরএসএস-এর শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে। এমনকি দলিত আর আদিবাসী গ্রামগুলো পর্যন্ত তারা কব্জা করেছে। ফলে তারা যে কোনো কিছু সহজেই এক্সপেরিমেন্ট করতে পারে। ওদের আটকাবার কেউ থাকে না।”
গোধরা কান্ড হবার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজরা বন্ধ্ ডাকে আর বন্ধ্ চলাকালীন আমেদাবাদ শহরের প্রত্যেক মহল্লায় ২০০০-১৫০০০ লোকের পৃথক পৃথক জমায়েত তৈরি করে। এমনটা নয় যে, এক জায়গা থেকে একটাই দল তাণ্ডব চালাতে চালাতে এগিয়েছে, বরং আলাদা আলাদা জায়গাতে লোক জমায়েত করে সেখানে একই সময়ে তান্ডব শুরু করে। গোটা গুজরাটের আরএসএস, বজরং দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির গোটা সংগঠনটাই জমা হয়েছিল আমেদাবাদে। নিঃসন্দেহেই, এই গণহত্যার বাস্তব কারিগর তারাই।
আজ শুধু গুজরাটেই না, গোটা ভারতবর্ষেই মোদী সরকার এই মডেলই তৈরি করতে চাইছে। মুসলমানদের শত্রু প্রতিপন্ন করে তাদের ডাক — ‘সব হিন্দুরা এক হোক’। ভারতবর্ষের হিন্দু ভোটের একত্রীকরণই এদের প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। গরীব খেটে খাওয়া মানুষদের ধর্ম আর জাত-পাতের চালে ঘুলিয়ে দিতে পারলেই কিস্তিমাৎ। ওরা চায় সকলে ভাবুক ‘মুসলমানরাই দেশের শত্রু — তাই ওদের মারো’। দেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক বানিয়ে রাখাই বিজেপি ও আর.এস.এস-এর মত রাজনৈতিক ভাবধারা। এমনকি মুসলমানদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানেরও অধিকার দেবার দরকার নেই বলেই মনে করে তারা। তাই পশুদের হুঙ্কার : ‘এটা আমাদের রাষ্ট্র, হিন্দু রাষ্ট্র’। গুজরাট মডেলের এটাই পলিটিক্যাল অবজেক্টিভ। আসলে এ দাঙ্গার জমিন ওরা সেদিন থেকেই তৈরি করল যেদিন থেকে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ — হিন্দু আর মুসলমানকে পৃথক করার জন্য দুটো আলাদা শব্দ হয়ে গেল। বলে দেওয়া হল যে হিন্দুদের দেশ ‘হিন্দুস্তান’ আর মুসলমানের দেশ ‘পাকিস্তান’; হিন্দুদের ওপর মুসলমানদের আক্রমণের ইতিহাস গড়া হল সোমনাথ মন্দির, অযোধ্যা রাম মন্দির নির্মাণ কিংবা গোধরার কান্ড দিয়ে। আর যখন অন্ধত্বের বাজার বসে তখন লাশের ব্যাবসা কেউ আটকাতে পারে না। আমেদাবাদের একটি নামী স্কুল ‘বাপুনগর’-এ এরকম হাজার হাজার শিশু দেখতে পাওয়া যাবে যাদের শৈশব বিষিয়ে গেছে মুসলিম-বিদ্বেষে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমাদের মানবিকতা তো কেড়ে নিলই, একটা নিষ্পাপ শিশুর শৈশবকেও ছাড়ল না।
এই গুজরাটের নির্মাতারা আজ দেশের শাসক হয়ে বসেছে। লোকসভা নির্বাচনে দেশের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর থেকে একদিকে যেমন নয়াউদারবাদী অর্থনীতির বাধ্য সন্তান হিসেবে নোটবন্দী এবং জিএসটি-র মত চরম জনবিরোধী অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহন করেছে, তেমনই অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক হিংসার ভয়াবহ বাতাবরণ তৈরী করেছে কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অসম, কর্ণাটক — সর্বত্র! সেদিনের সেই নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য ভারতের কর্পোরেটমহল প্রায় ৩৮০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। বলাই বাহুল্য যে মোদী এই কর্পোরেটদেরই স্বার্থ পূরণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই মোদী আর কর্পোরেটদের এই অশুভ আঁতাত যে ভারত বানাতে চায়, তা অর্থনৈতিক দিক থেকে যেমন দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষকে নয়া-উদারবাদের যাঁতাকলে পিষে মারবে তেমনই অন্যদিকে দেশের মেহনতী জনসমষ্টির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ মারফৎ তাদের সংগঠিত লড়াইকে ধ্বংস করবে পরিকল্পনামাফিক। ভুললে চলবে না গুজরাট দাঙ্গার পরবর্তী সময়ে সে রাজ্যের সমস্ত ট্রেড-ইউনিয়নগুলির কোমর ভেঙ্গে দেওয়া হয়—সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন কার্যত ধ্বংস হয়ে যায়।
দেশের তামাম মেহনতী জনতাকে, তাই লড়াই করতে হবে একদিকে তাদের নিজেদের মধ্যেকার সম্প্রদায়গত বিদ্বেষমূলক রাজনীতির বিরুদ্ধে যা আর.এস.এস-বিজেপি-র পরিকল্পনাপ্রসূত, অন্যদিকে তাকে সংগ্রাম করতে হবে এই আর.এস.এস-বিজেপি-র পিছনে থাকা দেশ ও দুনিয়ার তামাম মালিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে — তাদের ক্ষমতার স্তম্ভকে মূল থেকে উপড়ে ফেলে মেহনতীরাজ কায়েম করার
তথ্যসূত্র :
1. স্ক্রোল ডট ইন
2. দ্য ওয়্যার
3. কমব্যাট ফ্যাসিজম : সৌমিত্র দস্তিদার
4. প্রেস রিলিজ, গুজরাট সরকার, ২৭ শে ফেব্রুয়ারী, ২০০২
দৃশ্য ঋণঃ সৌমিত্র দস্তিদার
মূর্চ্ছনা পান্ডা পিপ্ল্স্ ব্রিগেডের সদস্য।