গুজরাট নির্বাচনের ফলের দিকে চেয়ে ছিল গোটা দেশ। একটা ধারণা জন্ম নিয়েছে, বিশেষত রাজনৈতিক মহলে, যেন এই ফলই ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পূর্বাভাস। গোটা দেশে ফলাফল সম্পূর্ণ বা প্রায় একই রকম হবে, এমন আশা সকলে না করলেও, রাজনৈতিক লাইন গ্রহণের ক্ষেত্রে সবকটি দলই যে গুজরাটকে মাথায় রেখেই চলবে, কি বিজেপি কি বিজেপি-বিরোধীরা, তা কার্যত অনস্বীকার্য। কারণ বিজেপি-কে হারাতে এখানে কংগ্রেসের সাথে জোট বাঁধে তিন জনপ্রিয় যুবক নেতা জিগ্নেশ-অল্পেশ-হার্দিক-এর সংগঠনগুলি, যথাক্রমে রাষ্ট্রীয় দলিত অধিকার মঞ্চ, ওবিসি-এসসি-এসটি একতা মঞ্চ এবং পাতিদার আনামত আন্দোলন সমিতি। এই সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী দলগুলি নির্বাচনে দাঁড়ায়ও হয় কংগ্রেসের টিকিটে অথবা তার সমর্থনে নির্দল হিসাবে। ফলে আখেরে ভোটের লড়াই এসে দাঁড়ায় বিজেপি বনাম কংগ্রেস – এই দ্বিমুখী প্রতিযোগিতায়। কাঁটায় কাঁটায় টক্করে অবশেষে বিজেপি ৯৯ — কংগ্রেস (৭৭+৩) মার্কশিট নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল উভয় দলকেই। কেউ বললেন মোদী-অমিত শা জুটির জয়রথ অব্যাহত, কেউ তুলে ধরলেন ‘নয়া-রাহুল’-এর হাত ধরে কংগ্রেসের উত্থানের গাথা। স্বাভাবিক ভাবেই রাজনৈতিক মহলে কনফিউশন বেড়ে গেল বহুগুণ; কি কংগ্রেস, কি প্রধান প্রধান আঞ্চলিক দলগুলি, কি বামপন্থী পার্টিগুলি, সকলেই পড়ে গেল চরম দ্বিধায়; আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-র বিকল্প হিসাবে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট, না তৃতীয় ফ্রন্ট, না কি বিজেপি-বিরোধী মহাজোট? আগামী দেড় বছর এ জল্পনা চলবে চরম তীব্রতায়, কর্পোরেট মিডিয়ার টিআরপি উঠবে তুঙ্গে, ফাটকা কারবারের রমরমা, কর্পোরেট মালিকদের আরও আরও সম্পদের পাহাড়। আর জনগণ !

গুজরাট নির্বাচনের ফলাফল একটু তলিয়ে দেখলে (বলা ভাল, একটু নিচে নেমে দেখলে, কর্পোরেট মিডিয়ার হাওয়ায় উড়ে না দেখলে) কিন্তু বেরিয়ে আসে অত্যন্ত আলাদা ধরণের কিছু বৈশিষ্ট্য। তার সাথে যদি যোগ করা যায় হিমাচলের ফল, তবে সেগুলি আরও পুষ্ট হয়।

গুজরাট ও হিমাচল উভয় রাজ্যেই বিজেপি প্রায় ৪৯% (কংগ্রেসের চেয়ে ৮% বেশি) ভোট পেয়ে সরকারে এলেও ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় তার প্রাপ্ত ভোট কমেছে যথাক্রমে ১১% ও ৬% (৬০% ও ৫৪% থেকে ক’মে)। মনে রাখা দরকার, ই.উপি. ও উত্তরাখণ্ডেও বিজেপি সরকারে এলেও এই দুরাজ্যেও তাদের ভোট লোকসভা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হারে কমেছিল। ‘মোদী-ম্যাজিক’ যে ক্রমশই তার আকর্ষণ হারাচ্ছে, তা এ তথ্য থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। শুধু আসন সংখ্যা কমে যাওয়াই নয়, গুজরাটে যে বিজেপি-নেতৃত্বই জনগণের আস্থা হারিয়েছে, তা উঠে আসে যখন দেখা যায় উপ-মুখ্যমন্ত্রী নিতীন প্যাটেল জেতেন মাত্র ২২০০ ভোটে। শুধু গুজরাটেই নয়, হিমাচলেও দেখা গেল বিজেপি-র খোদ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে প্রজেক্টেড প্রার্থী প্রেম কুমার ধুমাল নিজেই নির্বাচনে হেরে গেলেন।

কিন্তু গুজরাটে দুই দশকেরও বেশী সময়ের শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়াতেও যাদের নৌকার পাল কাজে দিল না, সেই কংগ্রেসকে যারা বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সহায়ক ভাবছেন, রবি ঠাকুরের কথায় বলতেই হয়, তাদের “ভাবনার জন্যই ভাবনা হয়”।

অন্যদিকে যে তিন যুবককে সামনে দাঁড় করিয়ে কংগ্রেস না জিতলেও এতটা এগতে পারল, তাঁদের প্রভাব? কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়ে দলিত নেতা জিগ্নেশ মেওয়ানি জিতেছেন প্রায় ২০ হাজার ভোটের ব্যবধানে, আর কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়ে ওবিসি নেতা অল্পেশ ঠাকুর জিতলেন প্রায় ১৮ হাজার ভোটে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বয়স কম থাকায় হার্দিক নিজে দাঁড়াতে না পারলেও তাঁর প্রচারকে কাজে লাগিয়েই কংগ্রেস সৌরাষ্ট্র কার্যত ছিনিয়ে নিতে পারল বিজেপির থেকে, যেখানে মধ্য গুজরাটে নিজেদের জেতা সিট হারিয়েছে তারা। এপ্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন উঠে আসেই : ১৮ বছরে নির্বাচনের অধিকার থাকলেও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার নেই কেন? হার্দিক প্রসঙ্গে এইটেই প্রধানতম সওয়াল। 

তবে এই সকল ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয় যে, আপাতভাবে গুজরাটের নির্বাচনকে বিজেপি বনাম কংগ্রেস হিসাবে দেখা গেলেও জনগণের জন্য বিষয়টা কিন্তু এমন সরল ছিল না। গত প্রায় দুই দশকের বেশী সময় ধরে বিজেপি শাসনের পর দেখা যাচ্ছে শিশুদের প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার সুযোগের নিরিখে দেশের ৩৫ টি রাজ্য ও কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলের মধ্যে গুজরাটের স্থান ৩৩ নম্বরে, যে তথ্য তুলে ধরছে স্মৃতি ইরানির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। প্রায় ৫ কোটি আবাদীর গুজরাটে মাত্র সাড়ে বারো ’শ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দক্ষ শ্রমিকদের ঘোষিত গড় মজুরী মাসে ৮ হাজার টাকা। গত পাঁচ বছর ধরে গড়ে ৫০০-রও বেশী কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। দলিত ও সংখ্যালঘু মানুষের হাল-হকিকত কাররই অজানা নয়। নেতা মন্ত্রীদের দুর্নীতি সামাল দেওয়া দায়। এহেন অবস্থায় জনগণ যে সরকারের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়তে বাধ্য তা তো স্বাভাবিক! আসলে এই দুই দশকে গুজরাটে বিজেপি সরকার তা-ই করেছে, গোটা দেশে কংগ্রেস সরকারে থেকে যা করে এসেছে; – নয়া-উদারবাদ-এর কবরে নির্লজ্জ ভাবে ঠেলে ফেলে দিয়েছে জীবন্ত মানুষকে। ফলে, পণ্ডিতেরা ও রাজনৈতিক বিজ্ঞরা যতো তর্কই জুড়ুন না কেন, কোটি কোটি মেহনতী জনগণের জন্য বিজেপি আর কংগ্রেস মুদ্রার দুই পিঠ ছাড়া আর কিছুই নয়, ভোট মানে যে সকল মানুষের কাছে : “হেড ইউ উইন, টেল আই লস্‌”!

 

কিন্তু তিন যুবক নতুন কিছু উপাদান নিয়ে এ রঙ্গমঞ্চে হাজির হন। ওবিসি নেতা অল্পেশ কার্যত দক্ষিণপন্থী ধারাতেই নিপীড়িত মানুষের আওয়াজ তোলেন, এবং ফলে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ায় অবশেষে কংগ্রেসেই নিজের স্থান করে নেন। এপথেই চললে আগামী দিনে আলাদা করে তাঁকে আর চেনা যাবে কিনা সন্দেহ। তাঁর দাবীও ক্ষয় পেতে পেতে অবলুপ্ত হবে। জিগ্নেশ কিন্তু গুজরাটের দলিত মানুষের আওয়াজ হয়ে উঠেছিলেন শ্রেণীর প্রশ্নটিকে সামনে রেখে। বিজেপির হিন্দুত্ব ও শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে তাঁদের স্লোগান ছিল : “গাই কা পুছ তুম রাখো, হামে হামারি জমিন দো”। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহাজোটের লাইন নিয়ে তাঁরা আঁকড়ে ধরলেন একদিকে কংগ্রেস এবং অন্যদিকে হার্দিক প্যাটেলের উদ্যোগকে।

গুজরাটের উচ্চবর্ণ পতিদারদের সংরক্ষণের দাবী নিয়ে যে হার্দিক হাওয়া তুললেন, যা স্বাধীনোত্তর ভারতে উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক আধিপত্যের ঘৃণ্যতম উদাহরণগুলির মধ্যে একটি, তাদের এই আধিপত্যবাদের সাথেই হাত মেলালেন উচ্চবর্ণদের হাতে কয়েক হাজার বছর ধরে নিপীড়িত হওয়া মানুষকে যিনি সদ্য মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেই জিগ্নেশ। তিনি নিজে প্রথমবারেই ভোটে জিতে গেলেও নিপীড়িত মানুষের বিশ্বাস ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে। অন্যদিকে, পতিদার আন্দোলনের মুখ্য স্পন্সর হল আসলে গুজরাটের বেনিয়া গোষ্ঠী, যাদের দর-কষাকষি চলছে মোদী সরকারের সঙ্গে। কারণ সদ্য চালু হওয়া জিএসটি, দেশী-বিদেশী বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর বিপুল মুনাফা সুনিশ্চিত করতে তুলনায় এই মাঝারি মানের (আসলে এরাও নেহাত কম নয়) বেনিয়া গোষ্ঠীর মুনাফার ভাগে হাত বসিয়ে গ্রাস তুলে নিচ্ছে, যদিও তার আসল কোপ পড়ছে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের ওপর প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় প্রতিটি সামান্য জিনিস কেনা-কাটির সাথে সাথে। ফলে অভিজাত-সংরক্ষণের ঘৃণ্য প্রচার ও আন্দোলনের আড়ালে আরও ঘৃণ্য খেয়োখেয়ি চলছে পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যে, মেহনতী জনগণকে শুষে খাওয়ার অধিকার নিয়ে কাড়াকাড়ি বই যা আর কিছুই নয়। ফলে বুর্জোয়া সমাধানেরই পথ নিল বিজেপি; জিএসটি-তে কিছু ছাড় আর ৩৮ জন ‘প্যাটেল’ পদবীর প্রার্থী। জিতলেন ২৪ জন। হার্দিকের প্রচার কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস ৩৫ জন ‘প্যাটেল’ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে জেতাল ১০ জনকে।

আখেরি ফলটি তাই বিজেপি জিতল কংগ্রেস হারল এমন দ্বিমুখী আদৌ নয়। অমিত শা ১৫০ টি আসন পাবেন বলে দাবী করেছিলেন; বিজেপি সরকারে রয়ে গেল, কিন্তু ব্যাপক জনসমর্থন হারাল সে। কংগ্রেসের সিট বাড়ল অনেক খানি, কিন্তু বিরোধী আসনেই থাকতে হল তাকে। আর এই নির্বাচনের প্রধান আকর্ষণ ‘থ্রি মাস্কেটিয়ারস’-এর সব কিছু চলে গেল ভবিষ্যতের হাতে। কারণ এ লড়াই ছিল বহুমুখী, যদিও প্রধান তিনটি দ্বন্দ্ব সে হাজির করেছিল। গুজরাটের শাসকশ্রেণীর প্রতি শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের চরম ক্ষোভ, যা বিজেপির বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে; জনগণের ওপর নয়া-উদারবাদী শোষণ ও দমন, যা কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়ের বিরুদ্ধে গভীর ভাবে কাজ করেছে; আর বড় কর্পোরেটদের সাথে রাজ্যের বেনিয়া গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব, যাতে এই দুপক্ষ প্রথম দুটিকে কাজে লাগিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছে।

নয়া-উদারবাদের প্রতিক্রিয়ায় রক্ষণশীলতার হাত ধরে নয়, বরং তার আরও আক্রমণাত্মক প্রয়োগের মধ্যে দিয়েই আজ ফ্যাসিবাদ মাথা চাঁড়া দিচ্ছে। তাই ফ্যাসিবাদ আর ফ্যাসিবিরোধী মহাজোট এই দ্বিমুখী ভাবে তাকে বিচার করাটা একটা চূড়ান্ত ‘সেকেলেপনা’। গুজরাটে তো তবুও বিজেপি-র বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ছিল, অন্যান্য রাজ্যে অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি তো আঞ্চলিক দলগুলোর বিরুদ্ধে। সেখানে এ হেন মহাজোট গোটা অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ভোটকেই কেন্দ্রীভূত করবে বিজেপির ঘরে, আর তার জয়কে আরও সুনিশ্চিত করবে। আর সে অভিজ্ঞতাই কি রোজ হচ্ছে না আমাদের! ‘ফ্যাসিবিরোধী মহাজোট’ আসলে বর্তমান ভারতের প্রেক্ষাপটে চূড়ান্ত রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, এবং আখেরে তা ফ্যাসিবাদের উত্থানকেই সুনিশ্চিত করবে। ‘গুজরাট’ যদি ‘মডেল’ হয়, বিপদ কিন্তু বাড়বেই!

এর আগে “হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ না কি অন্য কিছু ?” শীর্ষক লেখায় (জবরদখল, ৬ই ডিসেম্বর, ২০১৭) আমরা স্পষ্ট করে বলেছিলাম, “আজ বিজেপি-র মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ-এর উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান লাইন হতেই হবে ‘নয়া-উদারবাদ’-এর বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম। …এদেশে নয়া-উদারবাদ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কৃষি-অর্থনীতির, জমি লুঠ থেকে শুরু করে ফসলের নিচু দাম চাপিয়ে দিয়ে”। গুজরাট নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আমাদের লড়াকু সমস্ত বামপন্থী সাথীদের উদ্দেশ্যে একটা দিক বিশেষ ভাবে তুলে ধরতে চাই : গুজরাটের শহরগুলিতে বিজেপি আগের বারের তুলনায় যেখানে মাত্র ৪ টি সিট খুইয়েছে, গ্রামগুলিতে সে সিট হারিয়েছে ১৮ টি।

বর্তমান ভারতে বিজেপির আজকের ফ্যাসিবাদী উত্থান রোখবার প্রধান অক্ষ হতেই হবে সংগঠিত কৃষক আন্দোলন।

 

 বাসুদেব নাগ চৌধুরী ‘পিপ্‌ল্‌স্‌ ব্রিগেড’ সংগঠনের সদস্য।  

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *