গত বিশ বছরে আমাদের চারপাশের সমাজ ও প্রকৃতি-র চেহারাটাই বদলে গেছে। আর তার সাথে সাথে দুনিয়াজোড়া মেহনতী মানুষের লড়াইয়ের প্রাণকেন্দ্র যে কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং তার আশে-পাশে বেড়ে ওঠা বামপন্থী আন্দোলন, তার ক্ষেত্রেও ঘটে গেছে এক আমূল পরিবর্তন। তাদের নিজস্ব বিতর্কের মর্মবস্তুটাই নতুন রূপ ধারণ করেছে। যে চিরাচরিত ‘বিপ্লবী’ লাইন ও ‘সংশোধনবাদী’ লাইনের দ্বন্দ্বের মধ্যে থেকে বিকশিত হয়ে এসেছে কমিউনিস্ট আদর্শ, তা আজ দৃশ্যতঃ লুপ্ত। ‘বিপ্লব’ শব্দটা অবশ্য হারিয়ে যায়নি, উল্টে রাজনীতির বিশ্ববাজারে তার ‘মার্কেট ভ্যালু’ আজও বিশাল, যদিও ‘সংশোধনবাদ’ শব্দটার কারখানা কার্যত ‘লক আউট’ হয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী পার্টিগুলোর অ্যাজেন্ডা ও তাদের অভ্যন্তরীণ বিতর্কগুলির দিকে তাকালেই দেখা যায়, এ যুগে তাদের দ্বন্দ্বের মর্মবস্তু হল ‘নয়াউদারবাদী’ লাইন বনাম ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসী’। একদিকে আধুনিক সুবিশাল শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিকদের শ্রেণী-সংগ্রামের স্বার্থে এবং ‘জবলেস গ্রোথ’-এর বিরোধিতার নামে আদতে বড়ো বড়ো কর্পোরেটদের অ্যাজেন্ডাতেই পার্টিগুলোকে চালাতে চাইছে ‘প্রথম লাইন’; আর অন্যদিকে, ‘দ্বিতীয় লাইন’ চাইছে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের শেষ সম্বল রক্ষা আর ‘সরকারি মিতব্যায়িতা’-র বিরোধিতার নামে ছোট ও মাঝারি-মালিকানা নির্ভর প্রতিযোগিতার যুগে ফিরে যেতে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতিকর দিকগুলির বিষয়ে প্রথম পক্ষ প্রশ্নগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয় এই বলে যে, প্রকৃতির উপর প্রভুত্বই মানবসভ্যতার এগিয়ে চলার ইতিহাস; আর দ্বিতীয় পক্ষ চায় এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে মানুষের ‘ভোগবাদী লিপ্সা’কে নিয়ন্ত্রণ করতে।
চীন দেশের এই ‘নয়াউদারবাদী’ লাইনের কমিউনিস্ট নেতারা, যাঁরা দেঙ্ জিয়াও পিঙ-এর “উন্নয়ন এক লৌহকঠোর বাস্তবতা” — স্লোগানটিকে সামনে রেখেই চলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য বো জি লাই আওয়াজ তোলেন “জনগণের জীবন-জীবিকাও এক লৌহকঠোর বাস্তবতা”। লাটিন দেশগুলিতে উগো সাভেজ, ইভো মোরালেজ ও রাফায়েল কোরেয়া-র উত্থানকে ‘সমাজতন্ত্র’ বলে প্রচার আদতে ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’-রই পক্ষে মত তৈরির প্রয়াস। ভারতবর্ষে শিল্পায়ন ও জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে সিপিআই (এম), যা এদেশের সবচেয়ে বড়ো কমিউনিস্ট নামাঙ্কিত পার্টি, তার কার্যত সমান্তরাল দুই শিবিরে পরিণত হওয়া এবং বাকী সব বামদলগুলোর ‘পোলারাইজ্ড্’ হয়ে তারই দুপাশে ভিড় করার ঘটনাও আসলে এই দুই লাইনের দ্বন্দ্বেরই আত্মপ্রকাশ। ইউরোপের বুকে গ্রিসে সাইরিজা, স্পেনে পোডেমস, ইতালিতে ফাইভস্টার আন্দোলন-কে কেন্দ্র করে, তাদের ঐক্য ও ভাঙ্গনের মূলেও কাজ করছে এই ‘নয়াউদারবাদী’ লাইন বনাম ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’-র দ্বন্দ্বই। আমেরিকার ওয়ালস্ট্রিট দখলের আন্দোলনের অন্যতম ডেমোক্র্যাট নেতা স্যান্ডারস্ কিংবা সদ্য ইউ কে -র লেবার পার্টির নেতা হিসেবে উঠে আসা করবীনও প্রথম লাইনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় লাইনের প্রবক্তা। এসব থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কেবল এ বিষয়টাই যে এই দুই লাইনেরই গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণীগত সামাজিক ভিত্তি আজ দুনিয়াজুড়ে বিরাজ করছে।
গত দু’শ বছরের ইতিহাস অনিবার্যভাবেই আমাদের এনে ফেলেছে আজকের নয়াউদারবাদের জমানায় যখন আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স পুঁজি গোটা বিশ্বের মেহনতী মানুষকে ভাগ করছে কতগুলি মুদ্রা-অঞ্চলে (যেমন ডলার, ইউরো, পাউন্ড, ইউয়ান, রুপি ইত্যাদি), আর প্রতিটি মুদ্রা-অঞ্চলের মেহনতী মানুষকে আবার একচেটিয়া (মনোপলি আর অলিগোপলি দুই-ই) শিল্পক্ষেত্রে (কম সংখ্যায়) এবং ছোট-মাঝারি উৎপাদন ক্ষেত্রের অবাধ প্রতিযোগিতায় (বিশাল সংখ্যায়)। মেহনতী মানুষের খাটুনির না পাওয়া দাম তথা ‘সারপ্লাস’-এর একটা বড়ো অংশ আজ ছোট উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে চলে যায় বড়ো বিনিয়োগকারীর হাতে, আর কম দামী মুদ্রা-অঞ্চল থকে বেশি দামী মুদ্রা-অঞ্চলে, — মুদ্রা মারফৎ বিনিময়ের ব্যবস্থায় ঢুকে থাকা জটিল হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে; যদিও আদতে একটা সরল বিশ্বদর্শন অনুসারে — ‘যার যতো ইনভেস্টমেন্ট, তার ততো প্রফিট’। আর এর ফলেই ছোট উৎপাদন ক্ষেত্র আর কম দামী মুদ্রা-অঞ্চলের মেহনতী মানুষের থেকে তোলা ‘সারপ্লাস’-এর অংশ থেকে ভোজের ভাগ দেওয়া হয় বড় বড় শিল্পক্ষেত্র আর বেশি দামী মুদ্রা-অঞ্চলের শ্রমিক-কর্মচারীদেরও। ফলে দামী মুদ্রা-অঞ্চলের বড় শিল্পের শ্রমিকরাই কেবল নয়, প্রতিটি মুদ্রা-অঞ্চলের বড়ো শিল্পক্ষেত্রের এহেন শ্রমিকরাও মালিকের জন্য ‘সারপ্লাস’ তৈরী করার বদলে উল্টে ছোট উৎপাদনের মেহনতী মানুষের ‘সারপ্লাস’-এর ভাগ পায়, আর তারাই কমিউনিস্ট তথা বাম আন্দোলনের ‘নয়াউদারবাদী’ লাইনের শ্রেণীভিত্তি। অন্যদিকে ছোট ও মাঝারি উৎপাদন ক্ষেত্রগুলির মেহনতী জনগণ, যারা আজ তৈরী করছে সামগ্রিক সামাজিক ‘সারপ্লাস’, তাদের একটা বিশাল অংশ নিজস্ব ক্ষুদ্র মালিকানা-ভিত্তিক উৎপাদক (যেমন কৃষক, স্বনিযুক্ত শ্রমজীবী, ছোট ছোট কারখানার শ্রমিক ইত্যাদি) বা তাদের কর্মচারী; তাদের বেঁচে থাকাটাই আজকের দিনে নির্ভর করে তাদের হাতে ঐ মালিকানাটুকু থাকবার উপর, যারা নিজেদের মধ্যে অবিরাম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে। বিশ্বব্যাপী কল্যাণকামী রাষ্ট্র আর নিজের মালিকানাটুকু নিজের হাতে রাখার বাইরে কী বা দাবী হতে পারে এদের ! এরাই ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’-র শ্রেণীগত উৎস।
তবে কি এই দুই লাইনের দ্বন্দ্বই আজকের যুগের সমাজবিকাশের ভিত্তি? ‘অস্তিত্ব রক্ষার’ জন্য ‘প্রতিযোগিতা’ আর ‘যোগ্যতমের উদ্বর্তন’ হিসাবে ‘একচেটিয়া’, অর্থাৎ ডারউইনবাদই কি আমাদের এ যুগের মানবসভ্যতার তত্ত্ব? উৎপাদন করতে না পারার কারণে যে ডারউইনবাদ পশুদের জীবনে দেখা যায়, এই কল্পনাতীত উৎপাদনের যুগেও মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করা কি তার পক্ষে সম্ভব? ‘বিপ্লবী লাইন’ ও ‘সংশোধনবাদ’-এর দ্বন্দ্ব কি সত্যিই লুপ্ত, না কি তা সুপ্ত হয়ে আছে? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা দুটি সহজ উদাহরণের সাহায্য নেব। একজন বড়ো শিল্পক্ষেত্রের মোটা টাকা মজুরি পাওয়া শ্রমিক, তার প্রবণতা কোনটি — সে একটা ভাল পরিমাণ টাকা জমিয়ে নিয়ে নিজের ছোট একটা কোম্পানি খুলবে, নাকি নির্দিষ্ট সময় কাজের বিনিময়ে সুখে-বিলাসে থাকবার মতো মজুরী/মাইনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে? অন্যদিকে, একজন রাস্তার ধারে চায়ের দোকানদার, তার চাহিদা কোনটা — নিজের একটা স্থায়ী ভাল দোকান হবে, না কি একটা ভাল আয়ের স্থায়ী কর্মসংস্থান হবে? বাস্তবে তো, যেমনটা আজ্ঞে ব্যাখ্যা করা হল, এই দুই শ্রমজীবীর প্রথমজন ‘নয়াউদারবাদী’ লাইনের শ্রেণী-প্রতিনিধি এবং দ্বিতীয়জন ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’-র; কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উভয়ের মধ্যেই, পেতিবুর্জোয়া (ছোট পুঁজির মালিক) সংশোধনবাদী লাইন অথবা মালিকানাহীন বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণীর লাইন, দুই-এরই এক দ্বান্দ্বিক প্রবণতা কাজ করছে। অর্থাৎ, আসলে আজকের দিনে শ্রমজীবীর আলাদা আলাদা অংশ এই দুই আলাদা লাইনকে প্রতিনিধিত্ব করছে না, তারা প্রত্যেকেই এককভাবে উভয় লাইনেরই প্রতিনিধত্ব করছে, আরও সঠিক ভাবে বললে উভয় লাইনের দ্বন্দ্বের প্রতিনিধত্ব করছে, যার ফলে কমিউনিস্ট তথা বাম আন্দলনে এই দুই লাইনের চোরাস্রোত বয়ে চলেছে। আর সেজন্যই শ্রমজীবীর কোনও শ্রেণী অংশ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আজকের দিনে বিপ্লবী লাইন উঠে আসবে না। চিনিতে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া জলে বাইরে থেকে সুতো নামাতে হবে, যাকে ঘিরে জমে উঠবে মিছরিটা।
(জবরদখল, অক্টোবর ২০১৫-এ প্রথম প্রকাশিত)
বাসুদেব নাগ চৌধুরী পিপ্ল্স্ ব্রিগেড-এর কনভেনর।