সিন্দ্রানী হাইস্কুল মাঠের প্রত্যেকটা ঘাস জানে যে স্পোর্টস শ্যু আর ট্রাক প্যান্ট পড়লে তিনি কি কঠিন হয়ে যান। বাজখাই গলায় ‘স্যার’ হাঁক পাড়লে ভয়ে তটস্থ হয়ে যায় তার কাছে প্রাকটিসে আসা ছেলেমেয়েরা। তাদের কেউ ১০০ মিটার দৌড়ে রাজ্য চ্যাম্পিয়ন, কেউ বা লঙ জাম্পে। বুধিয়ার কথাই ধরা যাক, সীমান্তবর্তী গ্রাম খয়রামারীর পিছিয়ে পড়া জনজাতির এই ছেলেটি লঙ ডিসটান্স রানার। বগুলা কলেজের শারীরশিক্ষার প্রথম বর্ষের এই ছাত্রটি যে লম্বা রেসের ঘোড়া তা আমায় প্রথমেই বললেন কোচ। বর্তমানে গৌর রায়ের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজ্যস্তরের সোনাজয়ী অ্যাথলিট বাপি শেখ। শুধু বুধিয়া নয়, কোচিং সেন্টারের প্রত্যেকটি ছেলেমেয়ের মনের কথা তিনি বোঝেন। মানুষটির নাম গৌর রায়, সিন্দ্রানী সাবিত্রী হাই স্কুলের শারীরশিক্ষার শিক্ষক। ৫৫-এও সমান ঋজু, নির্মেদ, ফিট । কলকাতা পৌরসভার লোভনীয় চাকরি , সাই-এর কোচ হওয়ার সুযোগ হেলায় ছেড়ে পড়ে রয়েছেন নিজের এলাকার ছেলেমেয়েদের কাছে খেলাধূলাকে পৌঁছে দেবেন বলে। গরীব প্রান্তিক তফশিলী জাতি অধ্যুষিত উত্তর ২৪ পরগণার বাগদা থানার সিন্দ্রানী গ্রামের মানুষের কাছে তিনি আজ মসীহা। নিজে ছিলেন একজন অ্যাথলিট, কলকাতা পৌরসংস্থায়  চাকরিও পেয়েছিলেন অ্যাথলিট কোটায়  কিন্তু ১৯৮৯-এ একদিন একটি মেয়ের দৌড় দেখে তাকে ভোরবেলা কোচিং করাতে থাকেন। সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে , আশেপাশের গ্রামের বহু ছেলেমেয়েও তার কাছে অনুশীলন করতে আসত।

শুরুটা ছিল এভাবেই, এরপরের কাহিনী তার নিজের হাতে লেখা। সম্পূর্ণ জেদের বশে কলকাতা ছেড়ে নিজের গ্রামের স্কুলে চলে আসেন শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে শুধুমাত্র কোচিংটা চালিয়ে যাবেন বলে। সাফল্যও আসতে থাকে দ্রুত, তাঁর আবিষ্কার করা প্রথম মেয়েটি মুক্তি রায়, কানাডায় বিশ্ব পুলিশ মিট-এ ১৫০০ মিটারে সোনা আনেন,আজ তিনি সি.আর.পি.এফ-এর কমান্ডান্ট। গৌর রায়ের কাছে কোচিং করে আজ পর্যন্ত ৩২৩ জন স্পোর্টস কোটায় চাকরি পেয়েছেন,বহু ছাত্রছাত্রী সেনাবাহিনী আধা-সামরিক বাহিনীতে কর্মরত। বর্তমানে তার কোচিং সেন্টারে ১৫০ এর উপর ছেলেমেয়ে আসে। ভোরবেলায় বাসে চেপে বনগাঁ, বগুলা, আইঁশমালী থেকে ছেলেমেয়েরা আসে ‘স্যার’ এর কাছে প্র্যাক্টিসে। পরিকাঠামো উন্নয়নে কিছু সাহায্য পেলেও একজন অ্যাথলিটের যে খাদ্য , পুষ্টি বা মানসিক সাহায্য প্রয়োজন হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই অমিল। দাঁত চেপে লড়াই করতে এবং বঞ্চনা দূরে ঠেলতে অ্যাথলিটদের গৌর রায়ের টোটকা উপেক্ষা আর অপেক্ষা। তাঁর বিশ্বাস এই মন্ত্রই সাফল্য আনবে। দৌড়োতে গিয়ে কোনো অসুবিধা দেখলেই ছুটে যান সেই ছেলেটির কাছে, ম্যাসাজ করে দেন কাফ মাসল। শারীরশিক্ষায় বি.পি.এড এই মানুষটি জানেন কখন সিন বোনে যন্ত্রণা হবে কখন মাসেল চোক করবে। অনুশীলনে আসা ছেলেমেয়েদের প্রত্যেক বিন্দু ঘাম ঝরানোর সাক্ষী গৌর রায় তাই স্যারের নাম করতেই একরাশ কৃতজ্ঞতা ঝড়ে পড়ে মুক্তি রায়ের গলায়।
পরিবারকে সময় দিতে অসুবিধা হয় না? স্কুলের চাকরি কিভাবে সামলান? এসব প্রশ্নের পরে হেসে গৌর রায় বলেন হয়ে যায় সময়। “ছেলেমেয়েদের জন্য আমি ঠিক সময় বের করে ফেলি। ওরাই যে আমার স্বপ্ন। তাতে অসুবিধা হলেও আমি পাত্তা দিই না। জহুরীর চোখ মুক্তি রায়, অমর মন্ডল, দীপিকাদের চিনতে ভুল করেনি। আজ তাঁর নজর পড়েছে ১২ বছরের দিব্যার উপর, সময়ই উত্তর দেবে তার। আর গৌর রায় আরও মেঠো পথ পাড়ি দেবেন কোনো অ্যাথলিটের সন্ধানে।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *