“ওরা যত মারবে, আমরা তত বাড়ব।” ঠিক এই ভাষাতেই নিজের উপর হওয়া বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন আক্রান্ত নাট্যকর্মী শুভঙ্কর দাশশর্মা। গত ১৫ই আগস্ট সন্ধ্যাবেলা দমদম স্টেশনের কাছে অটোস্ট্যান্ডে দুষ্কৃতিদের হাতে হেনস্থা হতে হয় নাট্যকর্মী শুভঙ্করকে। আজ তারই বিরুদ্ধে দমদম স্টেশনের কাছে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন কলকাতার বিশিষ্ট নাট্যকর্মীরা।

ঘটনার সূত্রপাত ১৫-ই অগস্টে, ঐদিন কলকাতার ‘একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের’ সামনের গাছতলায় সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ বিরোধী জমায়েতের আয়োজন করেন শুভঙ্কর দাশশর্মা, সৈকত পাল, সত্যজিত-সহ কিছু নাট্যকর্মী। সেখানে গেরুয়া সন্ত্রাসের শিকার রোহিত ভেমুলা, গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গী, পানসারে এবং দাভালকর- পাঁচজনের বিষয়ে পাঁচটি পুস্তিকা এবং তিনটি পথনাটক- আনকার্টেনড এর নাটক সফদর হাসমির ‘হত্যারে’, অ্যাkto নিবেদিত ‘এ মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ এবং আমাদপুর সম্প্রীতির শিশুদলের নাটক ‘চলছে চলবে’ প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়।

শুভঙ্কর জানান, অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফেরার সময় দমদম স্টেশনের বাইরে তার ওপর চড়াও হয় দুই দুষ্কৃতি। শুভঙ্কর ও তার সহশিল্পী, বন্ধু সৈকত দমদম স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন দুইজন অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তি এসে অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা শুভঙ্করকে দরকারি কথা বলার জন্য পাশে সরে আসতে বললে তিনি রাজি হন নি, তারপরেই তাকে পুলিশি কায়দায় পিছমোড়া করে টেনেহিঁচড়ে দমদম স্টেশনের চাতালের কাছে এনে ব্যপক মারধোর করা হয়।  দুষ্কৃতিরা শুভঙ্কর দাশশর্মার মাথায় আঘাত করে। চোখের ভেতর বাম লাগিয়ে দিয়ে তাকে ফেলে লাথি চালায় ‘বীরপুঙ্গবদ্বয়’।  কেন তাকে এভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে? এই প্রশ্ন  জানতে চাইলে তাকে বলা হয় যে, দিদিকে (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়)  অসম্মান করারই বদলা নিচ্ছে তারা। শুভঙ্করের মাথায় এবং শিরদাঁড়ায়  গুরুতর আঘাত করে  চম্পট দেয় দুষ্কৃতিরা।  সহশিল্পী সৈকত সেখানে উপস্থিত থাকলেও বিশালকায় গুন্ডাদেরকে আটকানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।  দুষ্কৃতিদের মারের পর শুভঙ্করকে হাসপাতালে নিয়ে যান সৈকত বাবু। দু’দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন শুভঙ্কর।

একজন নাট্যকর্মীর উপর আক্রমণের প্রতিবাদেই ১৮ই আগস্ট দমদম স্টেশন লাগোয়া বিবেকানন্দ মূর্তির পাশে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের শিল্পীরা। ছিলেন উপস্থিত  আক্রান্ত নাট্যকর্মী শুভঙ্কর, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত, অভিনেতা বাদশা মৈত্র, নাট্যব্যক্তিত্ব সৌরভ পালোধী, শিবপ্রসাদ নন্দী মজুমদার, গননাট্য সংঘের সম্পাদক দীপেন্দু পালিত প্রমুখ।

প্রত্যেকেই রাজ্য সরকার, মুখ্যমন্ত্রী তথা সংস্কৃতি মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দমদমের বিধায়ক তথা নাট্যকার ব্রাত্য বসুর প্রতি ক্ষোভ উগড়ে দেন। পাশাপাশি, পুলিশের ভূমিকা নিয়েও কটাক্ষ করেন তারা। গণনাট্য সংঘের সম্পাদক দীপেন্দু পালিত বলেন, “কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে করা একটি অনুষ্ঠানে রাজ্য সরকার এতটাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো যে তারা শুভঙ্করকে মারতে লোক পাঠিয়ে দিল”। একইসাথে তিনি এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি কনভেনশনের মাধ্যমে প্রতিবাদমঞ্চ গঠনের আহবান জানান। নাট্যকর্মীরা এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমির সামগ্রিক ভূমিকা নিয়েও  প্রশ্ন তোলেন। পরিচালক অনীক দত্ত তার ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’-কে কেন্দ্র করে ঘটনাক্রমের অভিজ্ঞতার কথা টেনে এনেই বলেন, “প্রতিবাদ সভা, পথসভার  পাশাপাশি আইনি পথে পুলিশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যদিও পুলিশের কী অবস্থা তা সবাই জানেন। থানার ভেতর নিজেরা মার খেয়ে তার কেস ফাইল করতেই এগারো ঘন্টা সময় লেগে যায়, আমাদের আর কী  বিচার করবে তারা ! তবুও আইনি পথে জোরদার লড়াই চালাতে হবে”। দমদমেই একটি পুজো কমিটির খুঁটিপুজোয় উপস্থিত থাকার কথা ছিল এলাকার  বিধায়ক ব্রাত্য বসু, সাংসদ সৌগত রায়ের । অনীক দত্ত তাই নাট্যকর্মীদের বলেন, “আমাদের উচিৎ অবিলম্বে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে  মুখোমুখি এই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, মিডিয়া এমনিতে আমাদের পাত্তা না দিলেও এই কাজ করলে মিডিয়ার এবং জনগণের সামনে অন্তত বিষয়টাকে খোলাখুলিভাবে নিয়ে আসা যাবে। এইটুকু প্রতিবাদসভা যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না ওদেরকে আটকানো যাচ্ছে, ততক্ষণ কিছু হবে না। ভবিষ্যতের কথা  বলে বা তাত্ত্বিক কথা না বলে, এই মুহূর্তে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তা করতে হবে তরুণদের হাত ধরে।” এই  মঞ্চ থেকে অন্যান্য আন্দোলনের ওপর সরকারের আক্রমণকেও তীব্রভাবে কটাক্ষ করেন তিনি। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, “মানুষের সামনে আজ কোনো বিকল্প নেই। তাদের সামনে এখন দুটো অপশন, একদলকে তারা দেখতে পাচ্ছে, যারা রোজ এই অত্যাচার চালাচ্ছে, আর একদল যারা আরও বেশি ভয়ানক।”  পাশাপাশি বিজেপিকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ২০২১ এর ভোট হবে তৃণমূল আর এক্স- তৃণমূলের মধ্যে।  শুধুমাত্র জটিল তত্ত্বকথার আলাপ আলোচনার বাইরে এসে গিয়ে তিনি জনগণকে নিয়ে শক্তিশালী লড়াই গড়ে তোলার কথা বলেন এবং নাটকের ও লড়াইয়ের ক্ষেত্রে পথনাটিকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে আনেন।

অভিনেতা বাদশা মৈত্র শুভঙ্করবাবুর ওপর হওয়া আক্রমণের মূল কারণকে সবার সামনে তুলে ধরে  শুভঙ্করবাবুর বন্ধু তথা সহশিল্পী সত্যজিতের ওপর হওয়া জুলুমবাজির ঘটনাকে সামনে আনেন। একটি পোস্ট শেয়ার করার কারণে সত্যজিতের ওপর পুলিশি প্রহসন চালানো হয় যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং তার প্রতিবাদেই সত্যজিতের পাশে ছিলেন শুভঙ্করবাবু, তারই শাস্তিস্বরূপ তার ওপর এই আক্রমণ। রাজ্যের মন্ত্রী তথা বিধায়ক ব্রাত্য বসুর প্রতি তীব্র ধিক্কার জানান বাদশা এবং ঊচ্চস্বরে তার শিল্পীসত্ত্বা নিয়ে প্রশ্নও তোলেন। এছাড়া, তিনি বলেন, “এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা সংস্কৃতি মন্ত্রীকে অবিলম্বে অপরাধীদের শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। কাপুরুষের মতো লুকিয়ে, একা পেয়ে আক্রমণ না করে ক্ষমতা থাকলে সামনে এসে আক্রমণ করুন “।

আক্রান্ত নাটকর্মী শুভঙ্কর দাশশর্মা তার ওপর হওয়া আক্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে জানান, “ওরা আমার মাথায় আর শিরদাঁড়ায় মেরেছে। এটাই ওদের কাজ, কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ দেখলেই এরা প্রতিবাদীর মাথা আর শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলতে চায়। এই আক্রমণ আমার ওপর নয়, সমস্ত মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর আক্রমণ, এটাই আমার কাছে চিন্তার। আমার অবস্থা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।কিন্তু , তাদেরও মনে করিয়ে দিচ্ছি প্রতিবাদীর মাথা এভাবে কোনোদিনও ভাঙা যায়নি, যাবেনা। আমাদের লড়াই আরও তীব্র হয়ে উঠবে নাটক থেকে রাস্তার আন্দোলনে-সর্বত্রই ”। গান, স্লোগান, বক্তব্যের মাধ্যমে প্রত্যেকেই রাস্তার লড়াই এবং শিল্পের মাধ্যমে লড়াইকে আরও জোরদার করে তোলার আহ্বান জানান।

অন্যদিকে একই দিনেই পুলিশ এসে ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে দুষ্কৃতি দের শনাক্ত করার চেষ্টা চালায়। ঘটনার তিনদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশের তরফ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ সকলে, এবং সেই ক্ষোভ নিয়েই সভা শেষ হওয়ার পর বিশিষ্ট জনেরা সহ উপস্থিত অন্যান্য শিল্পী ও শিল্পপ্রেমী মানুষেরা দমদম থানায় গিয়ে পুলিশের কাছে বিচারের পরিস্থিতি জানতে চেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলে পুলিশ স্বভাবজাতভাবেই আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।

তবে, এই লড়াই যে এই পথসভায় সীমিত না থেকে বৃহত্তর রূপ নেবে, তার কার্যত স্পষ্ট বার্তাই পাওয়া গিয়েছে যা এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে একান্ত আবশ্যিক। গোটা দেশে ও রাজ্যে সরকারের ভজনা করে বেড়াচ্ছেন কিছু শ্রেণির শিল্পী ও তথাকথিক বিশিষ্ট্যজন আর অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে একটা কথা বললেই দাঁত-নখ উঁচিয়ে দৌড়াচ্ছে, তাড়া করছে সরকারের পোষা গুন্ডা, পুলিশ থেকে সরকারের পূজারী শিল্পী ও বিদ্বজ্জনেরা। সেখানে দাঁড়িয়ে শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা রক্ষার্থে এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পথে নেমে লড়াই ছাড়া গত্যন্তর নেই।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *